বাংলা ব্যাকরণ এর গুরুত্বপূর্ণ সকল ভাবসম্প্রসারণ পিডিএফ ডাউনলোড

0
985

বাংলা ব্যাকরণ এর গুরুত্বপূর্ণ সকল ভাবসম্প্রসারণ

পিডিএফ ডাউনলোড

জ্ঞানহীন মানুষ পশুর সমান ভাবসম্প্রসারণ

মূলভাব: শিক্ষা-দীক্ষাহীন মানুষ হয় নির্বোধ, তার কোনো হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। জ্ঞান, বুদ্ধি, বিবেচনা ও বোধশক্তিহীন মানুষ পশুর সমান।

ভাবসম্প্রসারণ: মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। জ্ঞান, বুদ্ধি ও বিবেকের জন্যেই মানুষ এ শ্রেষ্ঠত্বের সম্মান লাভ করেছে। পশুর সাথে মানুষের পার্থক্য হলো মানুষ যেকোনাে বিষয় জ্ঞান দিয়ে পর্যালোচনা করে এবং বিবেক দিয়ে ভালাে-মন্দ বিচার করতে পারে। তবে মানুষ জন্ম থেকেই পরিপূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী হয় না। মানুষের মধ্যে জ্ঞান সুপ্ত অবস্থায় থাকে। ধীরে ধীরে যথাযথ অনুশীলনের মাধ্যমে জ্ঞানের বিকাশ ঘটে। অতএব যথার্থ ও পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে হলে প্রতিটি মানুষের জ্ঞানচর্চা করা অপরিহার্য। যে মানুষের সুপ্ত জ্ঞান বিকশিত হয় না অর্থাৎ জ্ঞানহীন অবস্থায় থাকে তার আর পশুর মধ্যে কোন পার্থক্য থাকে না। পশুর জ্ঞান নেই বলে সে নির্বোধ, জ্ঞানহীন ও বিবেকবুদ্ধিহীন। কারণ পশু নিজেকে ছাড়া অন্য কিছু বােঝে না। তার কাছে আপন-পর ভালাে-মন্দ ও ন্যায়-অন্যায়ের কোনাে পার্থক্য নেই। প্রয়ােজনে স্বগােত্রের যে কাউকে হত্যা করে আহার করে। জ্ঞানহীন মানুষের আচরণও তেমনি পশুর মতাে। তার মধ্যে জ্ঞানের আলাে প্রবেশ করেনি বলে সে হয় বিবেকবর্জিত। সে অজ্ঞতার অন্ধকারে ডুবে থাকে। ফলে হিংস্র প্রাণীর মতাে যেকোনাে অন্যায় কাজ করতে সে দ্বিধা করে না। এমনকি পশুর মতাে নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্যে আপনজনকেও হত্যা করতে দ্বিধা করে না। এভাবে জ্ঞানহীন মানুষরা মনুষ্যত্বের অবমাননা করে মানবজন্মের উদ্দেশ্যকে ব্যর্থ করে দিচ্ছে। তাই জ্ঞান অর্জনের কোনাে বিকল্প নেই। কারণ জ্ঞানই মানুষকে সৎ, সুন্দর ও আদর্শবান হয়ে বেড়ে উঠতে সাহায্য করে। মানুষের মনােজগৎকে পবিত্র করে পরিপূর্ণ মানুষরূপে গড়ে উঠতে সাহায্য করে জ্ঞান।

সুতরাং দেশ ও জাতির উন্নতিকল্পে সকলের অন্তরকে জ্ঞানের আলােয় আলােকিত করা উচিত। জ্ঞান মানুষকে পৃথিবীতে আপন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে। জ্ঞানই মানুষকে মহৎ করে। এখানেই মানুষ ও পশুর পার্থক্য।

 

জগতে সেই বেশি চায়, আছে যার ভুরি ভুরি, রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি

ভাবসম্প্রসারণ: পৃথিবীতে সম্পদশালীর সম্পদের প্রতি তৃষ্ণা দুর্নিবার । তাদের অসীম তৃষ্ণাকে চরিতার্থ করার প্রয়াসে অনাহারী ও নিরন্ন মানুষের সর্বস্ব কেড়ে নিতেও কুণ্ঠিত হয় না তারা।

ধনীদের দুর্নিবার সম্পদ-ক্ষুধা কোনোদিনই পরিতৃপ্ত হওয়ার নয়। তাই তারা ক্রমাগত ধন-সঞয়ে স্ফীত হয়ে উঠতে থাকে। সমাজের দুর্বল অংশকে শােষণ করেই দিনের পর দিন তারা ঐশ্বর্যশালী হয়ে উঠতে থাকে। অন্যদিকে সমাজের প্রান্তিক শ্রেণির মানুষ তাদের শােষণে সর্বস্বান্ত হয়ে সাজে পথের ভিখারি। বিত্তবানদের এই অতিরিক্ত বিত্ত-সংগ্রহের প্রবণতার কারণে সমাজে সৃষ্টি হয় অসাম্য । অনিবার্য হয়ে ওঠে অশান্তি, সংঘাত ও সংগ্রাম । তারা যত পায়, তত চায়। এমন বিবেকহীন মানুষেরা নানাভাবে অন্যের সম্পদ হরণ করে দিনের পর দিন নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করে চলে। তাদের এহেন সম্পদলিপ্সা যেমন তাদের প্রতিপত্তি বাড়িয়ে তােলে তেমনি এর ফলে ধনী-গরিব বৈষম্যও বাড়তে থাকে পাল্লা দিয়ে। আর এই বৈষম্যের জাতাকলে পিষ্ট হতে হয় প্রান্তিক শ্রেণির মানুষকে। অথচ মানুষে মানুষে এমন বৈষম্য কখনােই কাম্য নয়। আধুনিক বিশ্বে রাষ্ট্রগুলাে জনকল্যাণের উদ্দেশ্যেই চালিত হয়। আমাদের শিল্প, সংস্কৃতি ও শিক্ষা মানবিক বােধের নিরিখে বিভেদহীন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখায়। তথাপি সমাজের একটি অংশ অর্থসম্পদের প্রতি এতটাই মােহাবিষ্ট যে ব্যক্তি স্বার্থ ব্যতীত আর কিছুই প্রাধান্য পায় তাদের কাছে। সমাজের প্রান্তিক শ্রেণির মানুষ ক্ষুধায়-দারিদ্র্যে ধুকে ধুকে মরলেও এ বেদনা তাদেরকে ছুঁতে পারে না। মানুষের এমন দুঃখ-যাতনা দেখেও তারা পাষাণবৎ নিশ্চল থাকে। আর তাই আজকের দিনে বিশ্বের সকল শান্তিকামী মানুষের সাধনাই হল শােষণ এবং সামাজিক অবিচার দূর করে সামাজিক সম্পদের ন্যায়সংগত সমবণ্টনের মাধ্যমে পৃথিবীতে শান্তির এক পরিমণ্ডল সৃষ্টি করা। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, আধিক্যের গ্রাস থেকে মানবসমাজ আজও মুক্ত নয় । ধনীর ধন যতই বাড়ুক তার প্রত্যাশা থাকে আরও ধন লাভের। অথচ তাদের সামনেই সমাজের অধিকাংশ মানুষ ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের কষাঘাতে দিনাতিপাত করে। আর তাদের এ দুঃখকষ্ট ও যাতনার মূল কারণ ধনিকশ্রেণি সম্পদলিপ্সা ও আগ্রাসন।

বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নরঃ-

বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর ভাবসম্প্রসারণ

ভাবসম্প্রসারণ: মানবসভ্যতার অগ্রগতিতে নারী-পুরুষ উভয়ের অবদান সমান। সভ্যতার অগ্রগতির মূলে রয়েছে নারী ও পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা।

প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে নারী ও পুরুষের হাত ধরেই পৃথিবী সভ্যতার পথে এগিয়ে চলেছে। সভ্যতার এ অগ্রযাত্রায় মানবজাতির উভয় অংশের অবদানই গুরুত্বপূর্ণ । কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা যুগ যুগ ধরে বঞ্চিত, অবহেলিত ও নির্যাতিত হয়ে আসছে। এ বৈষম্যের অবসান হওয়া প্রয়ােজন। কেননা নারী ও পুরুষ উভয়ই মানুষ, এ দুই সত্তার মাঝে যে কারও অধিকার খর্ব হলে ব্যাহত হবে কাক্ষিত অগ্রগতি। মানুষ তার মেধা আর কায়িক পরিশ্রম দিয়ে তিল তিল করে গড়ে তুলেছে বর্তমান সভ্যতার তিলােত্তমা মূর্তি। এ নির্মাণ অভিযাত্রার নৈপথ্যে রয়েছে নারী ও পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা সভ্যতার বেদীমূলে পুরুষের পরিশ্রমের আর সংগ্রামের চিহ্ন খােদিত হলে তার সাথে স্বমহিমায় উজ্জ্বল হয়ে উঠবে নারীর সেবা আর কর্তব্যনিষ্ঠাও। সভ্যতাকে সাজাতে-গােছাতে পুরুষ দিয়েছে শ্রম। আর তাতে সর্বদা অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে নারী। সব যুগের সব দেশের মানুষের জন্য একথা সত্য। এখানে তাই স্বেচ্ছাচারিতার কোনাে সুযােগ নেই। তা সত্ত্বেও নারীদের অবদানকে অগ্রাহ্য করলে তা সামাজিক ভারসাম্যকে নষ্ট করবে। এমন অবস্থা কখনােই কাম্য হতে পারে না। পৃথিবীর সকল সভ্য সমাজ তাই নারীদের এ বিরাট ভূমিকাকে স্বীকৃতি দিয়েই উন্নয়নের পথে পা বাড়িয়েছে। প্রকৃতপক্ষে নর এবং নারী একে অপরের পরিপূরক। মানবকল্যাণের পথে তাই নারী-পুরুষ উভয়কেই অগ্রসর হতে হবে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালােবাসার অনুভূতির মধ্য দিয়ে।

পুরুষের শৌর্য-বীর্য আর নারী হৃদয়ের সৌন্দর্য, প্রেম-ভালােবাসার সম্মিলনেই বিশ্বের সকল উন্নতি সাধিত হয়েছে। তাই নারী, পুরুষের পারস্পরিক সহযােগিতার মধ্য দিয়েই কেবল পৃথিবীকে আরও সুন্দর করে গড়ে তােলা সম্ভব।

একই ভাবসম্প্রসারণের ভিন্ন প্রতিলিপন

মূলভাব : সৃষ্টির প্রথম থেকে এখন পর্যন্ত মানব সভ্যতার যে বিকাশ সাধিত হয়েছে, তা নারী-পুরুষ উভয়েরই যৌথ প্রচেষ্টার ফল।

সম্প্রসারিত ভাব : সমাজের বা জাতির উন্নতির জন্য পুরুষের পাশাপাশি নারীরও যে বরাট ভূমিকা রয়েছে তা অনস্বীকার্য। যে সমাজের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা নারী সে সমাজে নারীকে উপেক্ষা করে কোনাে প্রকার উন্নতি সাধন করা সম্ভব নয়। তাদেরকেও সব কাজে সমদায়িত্ব নিতে হবে। ইসলাম ধর্ম সমাজে নারীর মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে এবং শিক্ষার অধিকারসহ সকল অধিকার দান করেছে। সারা বিশ্বে পুরুষের পাশাপাশি নারীকেও কঠিন কর্তব্য সম্পাদন ও দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। ঘরে ও বাইরে তারা কর্মমুখর জীবনের স্বাদ লাভ করছে। পারিবারিক জীবনে তারা সুখ-শান্তির মাধ্যমে পুরুষের জীবনকে সুন্দর ও সার্থক করে তােলে। এতে পুরুষের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং জাতীয় জীবনে উন্নতির পথ প্রশস্ততর হয়। সেই সাথে নারীসমাজ পুরুষের সঙ্গে জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। সমাজ জীবনের কোনাে ক্ষেত্রেই নারীসমাজ পিছিয়ে নেই। জীবনের সর্বত্র নারীর অবদান বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। শুধু পারিবারিক জীবনেই নয়,

কর্মজীবনেও নারী জাতি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। মানুষ এখন এ কথা দ্ব্যর্থহীনভাবে মেনে নিয়েছে যে, মানব সভ্যতা গড়ার পেছনে নারীর অবদান পুরুষের চেয়ে কোনাে অংশে কম নয়। ফলে নারীর মর্যাদাও পুরুষের সমপর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। কাউকে বাদ দিয়ে কেউ এককভাবে কৃতিত্বের দাবিদার নয়।

মন্তব্য: নারী জাতিকে ছোট করে দেখার কোনাে অবকাশ নেই। একের দানে অনন্য পরিপুষ্ট। তাই সংসারে পুরুষ ও নারীর সমান প্রয়ােজনীয়তা রয়েছে।

বিদ্যার সাথে সম্পর্কহীন জীবন অন্ধ এবং জীবনের সাথে সম্পর্কহীন বিদ্যা পঙ্গু

বিদ্যার সাথে সম্পর্কহীন জীবন অন্ধ এবং জীবনের সাথে সম্পর্কহীন বিদ্যা পঙ্গু ভাবসম্প্রসারণ

মূলভাবঃ সার্থক জীবন গঠনে বিদ্যাশিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু সেই শিক্ষাকে অবশ্যই হতে হবে জীবনমুখী। শিক্ষাহীন জীবন এবং জীবন-সম্পর্ক বর্জিত শিক্ষা কোনোটিই কাম্য নয়।

ভাবসম্প্রসারণঃ মানবসন্তানকে প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠার জন্য জন্মের পর থেকে জীবনব্যাপী সাধনা করতে হয়। মানুষ হওয়ার সে সাধনায় বিদ্যার্জন তথা শিক্ষালাভ হচ্ছে অন্যতম প্রধান উপায়। বিদ্যার্জন মানুষকে মানবীয় গুণাবলিসম্পন্ন করে। বিদ্যা মানবজীবনের অন্ধকারকে দূর করে জীবনকে সার্থক ও পুণ্যময় করে তােলে। বিদ্বান ব্যক্তি নিজে যেমন মহীয়ান হন তেমনি তার অর্জিত বিদ্যার পুণ্যপ্রভাবে সমাজ ও দেশ হয় সমৃদ্ধ। অপরদিকে সমাজে বিদ্যাহীন লােকের কোনাে সমাদর নেই। বিদ্যা-প্রদেয়। আলাের অভাবে তারা সবদিক থেকে পিছিয়ে থাকে, চোখ থাকতেও থেকে যায় অন্ধ । তাদের কাছ থেকে সমাজ কিছুই আশা করতে পারে না। সর্বোপরি বলা যায়, বিদ্যা মানুষকে জীবনঘনিষ্ঠ আদর্শ মানুষ করে তােলে। বিদ্যার সঙ্গে সম্পর্ক না থাকলে মানুষ বৃহত্তর জীবনবােধ থেকে বঞ্চিত হয়। আবার, প্রকৃত বিদ্যাকে হতে হবে জীবনমুখী, কোনােমতেই জীবন-বিবর্জিত নয় । কারণ বিদ্যা যদি জীবনবিমুখ হয় তবে তা জীবনকে আলােকিত করতে পারে না, বরং তা জীবনকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেয়। জীবনবিমুখ বিদ্যা মানুষকে মানুষ করার বদলে অহংকারী অমানুষ করে তােলে। তাই বিদ্যাকে জীবনের বাস্তবানুসারী করে তুলতে হবে। অর্থাৎ জীবনের জন্য যেমন বিদ্যাশিক্ষার প্রয়ােজন তেমনি মানুষ হতে হলে জীবনঘনিষ্ট প্রকৃত বিদ্যা অর্জন করতে হবে । মনীষীদের জীবনের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই যে, জীবনমুখী শিক্ষার মাধ্যমে তারা তাদের জীবনকে সার্থক করেছেন, চারপাশের সমাজ ও বিশ্বকে দান করেছেন জ্ঞান ও আলাে। নিরস ও নিপ্রাণ বিদ্যা কখনােই ব্যক্তিত্বের এমন জাগরণ ঘটাতে পারে না। তাই জীবনকে সার্থক ও মহিমান্বিত করতে চাইলে আমাদেরকে অবশ্যই বিদ্যা অর্জন করতে হবে, তবে তা হতে হবে জীবনমুখী প্রকৃত বিদ্যা ।

বিদ্যাহীন জীবন অন্ধকারতুল্য। আবার যে বিদ্যার সঙ্গে জীবনের যােগ নেই তাকে প্রকৃত বিদ্যা বলা যায় না। তাই বিদ্যাহীন জীবন যেমন আমাদের কাম্য হতে পারে না, তেমনি জীবন-সম্পর্কহীন বিদ্যাও অগ্রহণযােগ্য এ দুটো হতে হবে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত।

একই ভাবসম্প্রসারণের ভিন্ন প্রতিলিপন

মূলভাব : বিদ্যার মতাে পরম ধন আর নেই। আমাদের সমগ্র অগ্রগতির মূলে রয়েছে বিদ্যা। কিন্তু এ বিদ্যা যদি মানব।

জীবনের সাথে সম্পৃক্ত না হয়, তবে তা হয়ে পড়ে অর্থহীন।

সম্প্রসারিত ভাব : বিদ্যা হচ্ছে জ্ঞানার্জন শলাকা। বিদ্যা তিমির বিদারী, বিদ্যা জ্ঞান-চক্ষুর উন্মােচক। বিদ্যা এনে

দেয় যশ, কল্যাণ। বিদ্যা হলাে গুরুর গুরু। মানবের অনির্দিষ্ট অগ্রগতির মূল বিদ্যা। হাদিসে আছে, “বিদ্যার মতাে চক্ষু আর

নেই, সত্যের চেয়ে বড় তপস্যা আর নেই।” বিদ্বানের কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়ে পবিত্র। মােহের বশে যে বিদ্যা

নামক পরম ধনের তপস্যা থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখে তার মতাে অভাজন পৃথিবীতে আর নেই। জলে-স্থলে-নভে আজ

মানবের যে সাফল্য এর মূলে রয়েছে জীবনের সাথে সম্পর্কযুক্ত বিদ্যা। বিদ্যার দ্যুতি এমনই উজ্জ্বল যে, তার আলােকে সমস্ত

অন্ধকার বিদূরিত হয়। প্রবাদে আছে, “স্বদেশে পূজ্যতে রাজা, বিদ্বান সর্বত্র পূজ্যতে।” বিদ্বান ব্যক্তি সমস্ত বিশ্বের সম্পদ।

তবে, বিদ্যা নামক মহার্ঘতম বস্তুও যদি জীবনের সাথে সম্পৃক্ত না হয় তবে সে বিদ্যা অর্থহীন। বিদ্যার উদ্দেশ্য জীবনকে

সফলতায়, প্রাণকে প্রাণময়তায় উদ্বেল করে তােলা। উদ্দেশ্যহীন বিদ্যা ব্যর্থ ও পঞ্জ। কবির কথায়,

“যার বিদ্যা নাই সে না জানে ভালােমন্দ

শিরে দুই চক্ষু আছে তথাপি সে অন্ধ।”

মন্তব্য : আমাদেরকে অবশ্যই জ্ঞানার্জনের প্রচেষ্টা চালাতে হবে। আর তা হতে হবে জীবনের সাথে সম্পর্কিত বা জীবনঘনিষ্ঠ।

স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন

স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন ভাবসম্প্রসারণ

মূলভাব: পরাধীনতার নাগপাশ ছিন্ন করে স্বাধীনতা অর্জন করা অত্যন্ত দুরূহ কাজ। কিন্তু অর্জিত স্বাধীনতাকে যথার্থভাবে রক্ষা করতে আরও অনেক বেশি ত্যাগ, সাধনা, পরিশ্রম ও নিষ্ঠার প্রয়ােজন হয়। সর্বোপরি প্রয়ােজন দেশের জনগণের পারস্পরিক ঐক্য ও দেশপ্রেম।

ভাবসম্প্রসারণ: স্বাধীনতা সকলেরই কাম্য। স্বাধীনতা কথাটি যতই মধুর হােক না কেন, সহজ পথে তা লাভ করা যায় না। অনেক ত্যাগ, রক্ত ও জীবনের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়। পৃথিবীতে কোনাে জাতিই বিনা কষ্টে স্বাধীনতা অর্জন করতে পারেনি।কেবল স্বাধীনতা অর্জনই শেষ কথা নয়, বহু কষ্টে অর্জিত স্বাধীনতাকে রক্ষা করা আরও কঠিন। কারণ স্বাধীনতার শত্রুরা কখনােই অর্জিত স্বাধীনতার স্বাদ নির্বিঘ্নে ভােগ করতে দেয় না। স্বাধীনতা অর্জনের পর স্বাধীনতার বিপক্ষের শত্রুরা স্বাধীনতাকে বিনষ্ট করার জন্যে তৎপর হয়ে ওঠে। এ ধরনের শত্রু দেশের ভেতর ও বাইরে বিরাজমান থাকে। ভেতরের শত্রু যাতে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে, আবার বাইরের শত্রু যাতে তাদের সাথে হাত মিলাতে না পারে সেদিকে সকলেরই সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। অপরদিকে বিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠন করা ও দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা, অর্থনৈতিক উন্নতি করা খুবই কষ্টকর। সে কারণে কষ্টার্জিত স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতে দেশের নারী-পুরুষ সকলেরই মাঠে, কলকারখানায়, ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষ্টি ইত্যাদি দেশ গঠনমূলক কাজে আন্তরিকতার সাথে নিজেকে নিয়ােজিত করতে হবে। দেশের সকল নাগরিক যদি একতাবদ্ধভাবে দেশের অগ্রগতির জন্যে কাজ করে তবে স্বাধীনতা বিপন্ন হওয়ার ভয় থাকে না। স্বাধীনতা লাভের পর যদি দেশ অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল থাকে, দেশের জনগণ সচেতন না হয়, যদি জনগণ দেশপ্রেমিক না হয় তবেই স্বাধীনতা বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকে। একতাবদ্ধ নাগরিক দেশের যেকোনাে বিপদ মােকাবিলা করতে পারে দৃঢ়ভাবে। প্রয়ােজনে রক্ত ও জীবন বিসর্জন দিতে এরা দ্বিধা করে না।

স্বাধীনতা লাভ করলেই কর্তব্য শেষ হয় না, একে মর্যাদার সাথে রক্ষা করে পূর্ণতা দিতে পারলেই অর্থবহ হবে। স্বাধীন জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে সকলকেই পরিশ্রমী, দায়িত্বশীল, কর্তব্যপরায়ণ ও দেশপ্রেমিক হতে হবে।

একই ভাবসম্প্রসারণের ভিন্ন প্রতিলিপন

মূলভাব: যে কোনাে জাতির জীবনে স্বাধীনতা সূর্যকে ছিনিয়ে আনা কষ্টকর এবং তার চেয়েও কষ্টকর ঐ স্বাধীনতারক্ষা করা।

সম্প্রসারিত ভাব : স্বাধীনতা মানুষের অমূল্য সম্পদ। কোনাে মানুষই পরাধীনরূপে বেঁচে থাকতে চায় না। স্বাধীনতাঅর্জন অত্যন্ত গৌরবের ব্যাপার। তাই মানুষ স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করে, যুদ্ধ করে। স্বাধীনতা অর্জনের জন্য অবর্ণনীয়দুঃখ-কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করতে হয় এবং অমূল্য জীবন বিসর্জনের মাধ্যমেই স্বাধীনতা আসতে পারে। কারণ স্বার্থমগ্ন।শক্তিশালী বেনিয়া শাসকেরা সহজে কোনাে জাতিকে স্বাধীনতা দিতে চায় না; বহু কষ্টে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমেই তাছিনিয়ে আনতে হয়। স্বাধীনতা অর্জিত হলেই সংগ্রাম শেষ হয়ে যায় না; তখন বিজয়ী জাতির সামনে আসে স্বাধীনতা রক্ষারসংগ্রাম। এ সংগ্রামে আরাে বেশি ত্যাগ-তিতিক্ষা ও শক্তি-সামর্থ্যের প্রয়ােজন হয়। কারণ স্বাধীন দেশের ভেতরে ও বাইরেশত্রুর অভাব নেই। এরা সুযােগের সন্ধানে তৎপর থাকে সারাক্ষণ। যে কোনাে সময় সুযােগ পেলে হিংসাত্মক কার্যকলাপের।মাধ্যমে স্বাধীনতাকে বিপন্ন করে তুলতে পারে। সুতরাং, এ ধরনের প্রতিক্রিয়াশীল, মীরজাফরি চরিত্রের হিংসাত্মক দৃষ্টিথেকে দেশকে রক্ষার জন্য শক্তি ও বুদ্ধি প্রয়ােজন। যদিও তাদের পরাভূত করা কঠিন ব্যাপার। যথেষ্ট দায়িত্ব সচেতন, সদাসতর্ক, নিবেদিত প্রাণ, দেশপ্রেমিক ও শক্তিশালী না হলে স্বাধীনতাকে রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে।

মন্তব্য : স্বাধীনতা রক্ষা করা স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে কঠিন ও দুরূহ কাজ। তাই স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য সবাইকেপ্রাণপণ চেষ্টা করা উচিত।

পথ পথিকের সৃষ্টি করে না, পথিকই পথের সৃষ্টি করে

পথ পথিকের সৃষ্টি করে না, পথিকই পথের সৃষ্টি করে ভাবসম্প্রসারণ

মূলভাব: মানুষ ঘর থেকে বেরােলেই পথ চলে। আর চলতে চলতেই তৈরি হয় পথ । এ পথ পথিকেরই সৃষ্টি। পথ কখনাে পথিককে সৃষ্টি করতে পারেনি, আর সেটি অকল্পনীয়।

ভাবসম্প্রসারণ: পথিক অর্থাৎ মানুষ তার জীবনচক্রে গতির ওপর নির্ভর করে আপন ক্ষমতা, কর্মদক্ষতা, বুদ্ধি ও প্রজ্ঞা কাজে লাগিয়ে তৈরি করে চলেছে পৃথিবীর ও মানবজাতির কল্যাণের নানা পথ। সৃষ্টির উষালগ্ন থেকেই মানুষ মত্ত নানা সৃষ্টিশীল পথ তৈরিতে। ভাগ্যান্বেষণে মানুষ তৈরি করেছে দুর্জয় রহস্যের সন্ধানের পথ। সন্ধানী মানুষ সাধনা ও প্রচেষ্টা দ্বারা সকল বাধাবিপত্তি, প্রতিকূলতাকে তুচ্ছজ্ঞান করে সাহস ও সংগ্রামের পথ দেখিয়েছে। এ সাহসী ও সংগ্রামী মানুষ রচনা করেছে নতুন নতুন পথ । তারা এ পৃথিবীর বুকে আজীবন স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকবে। তাদের তৈরি পথ বেয়ে এগিয়ে চলছে বর্তমানের সাহসী মানুষ। মানুষই প্রথমে তৈরি করেছে সমগ্র পৃথিবীর মানুষে মানুষে মেলবন্ধনের পথ । বর্তমানে নতুন পথ সন্ধানীর তৈরি পথ এগিয়ে গিয়ে সৃষ্টি করছে আরও নতুন নতুন পথের। যুগে যুগে মহাজ্ঞানী, পণ্ডিতব্যক্তি ও ধর্মপ্রচারকগণ মানুষকে দিয়ে গেছেন সুন্দর ও আললাময় পথের সন্ধান। পথ কখনাে পথিককে সৃষ্টি করতে পারে না, আবার নিজে নিজে তৈরি হয় না। পথিকই নিজের ও দশের প্রয়ােজনে পথের সন্ধান করে বা তৈরি করে। আবার পথিক নিজের অগ্রযাত্রা এবং যাত্রা যাতে সহজতর হয় সেদিকে লক্ষ রেখে পথের সৃষ্টি করে। তবে সকল পথই সঠিক ও যথার্থ হয় না। কিন্তু জীবনসন্ধানী ও কৌতূহলী পথিক চেষ্টা চালায় গন্তব্যে পৌছার। না পারলে সেই পথ পরিহার করে অন্য পথের সন্ধান করে। পথ কখনাে এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারবে না। সে কারণে পথে যত বাধাবিঘ্নই আসুক না কেন, সন্ধানী মানুষ তাকে তুচ্ছ ও অতিক্রম করে আপন গন্তব্যের পথ খুঁজে নেয়। সুখী ও সুন্দর পৃথিবীর সন্ধানে তাই পথিক উদ্ভাবন করে চলেছে নতুন নতুন পথ ।

পথ তৈরি হয়েছে মানুষের প্রয়ােজনে। আমাদের সকলের উচিত মহাজ্ঞানী ও মহৎ ব্যক্তিদের সুন্দর পথকে অনুসরণ করা। আগামী প্রজন্ম আরও নতুন পথের সন্ধান করে মানবজাতির ও পৃথিবীর অগ্রগতি সাধন করবে।

একই ভাবসম্প্রসারণের ভিন্ন প্রতিলিপন

মূলভাব : পথিক জীবনচক্রে আবর্তনকারী মহাজীবনের রথ। সে গতির প্রতীক। পথিকের পদচিহ্নে অঙ্কিত হয় পথরেখা। যে মানুষ প্রথম পথ সৃষ্টি করে মানুষকে মানুষের সাথে মেলায় সেই তাে যথার্থ পথিক।

সম্প্রসারিত ভাব : জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাধনা ও নানা অজানা অধ্যায় অতিক্রম করার জন্য মানুষকে নিত্যনতুন পথ তৈরি করতে হয়। এক্ষেত্রে মানুষ যেমন পুরনাে পথে চলে তেমনি প্রয়ােজনে নতুন পথ তৈরি করে। সংকটাপন্ন মানুষ খুঁজে বের করে সংকট উত্তরণের পথ। এভাবে কাল-কালান্তরে দেশ-দেশান্তরে মানুষ রচনা করেছে সমাজ ও সভ্যতার অগ্রগতির অজস্র পথ। যে পথ একদা ছিল অভিনব, নব আবিস্কৃত শত-সহস্র মানুষের পদচারণায় সে পথ হয়েছে অতিপরিচিত। অন্যদিকে গতানুগতিক পথ চলা মানুষকে যখন গণ্ডিবদ্ধ করেছে, তখন মানুষ খুঁজেছে সম্ভাবনাময় নতুন পথ। নিজ নব লক্ষ্য অর্জনের জন্য মানুষ নিত্য রচনা করে চলেছে নিত্যনতুন পথ। পথ কোনাে পথিককে সৃষ্টি করতে পারেনি, পারবেও না। মানুষের মুক্তির জন্য যে সমস্ত মহাপুরুষ পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছেন তাঁরাই যথার্থভাবে ‘রসতীর্থ পথের পথিক। তাদের পথনির্দেশনা প্রতিটি মানুষের আত্মমুক্তির ক্রমিক পরিণাম। তাদের প্রদর্শিত পথে চলে প্রত্যেক মানুষ স্বমহিমায় ভাস্বর হয়ে উঠতে পারে। সারােয়ারে কায়েনাত হযরত মুহাম্মদ (স) প্রদর্শিত পথ বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের নিকট ম্যাগনাকার্টা। মহাজ্ঞানী মহাজনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আমরা যদি তাদের প্রদর্শিত পথে চলতে পারি তাহলে আমরাও বরণীয় ও স্মরণীয় হতে পারব।

মন্তব্য : উদ্যোগী পথিক সহজে তার গন্তব্যে পৌছার জন্য নিজেই নিজের পথ সৃষ্টি করে থাকে। আর স্বীয় সাধনায় সৃষ্ট পথই পথিকের চলার উপযােগী হয়ে নতুন দিগন্তের সন্ধান দেয়।

 

রাত যত গভীর হয় প্রভাত তত নিকটে আসে

রাত যত গভীর হয় প্রভাত তত নিকটে আসে ভাবসম্প্রসারণ

মূলভাব: সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা সবকিছু নিয়েই মানবজীবন। মানবজীবনে দুঃখ যেমন আছে তেমনি দুঃখের কালাে মেঘ ভেদ করে এক সময় দেখা দেয় সুখের সূর্য। কাজেই দুঃখ-দৈন্যে হতাশ না হয়ে, ধৈর্যের সাথে সাধনা করতে হবে সুখ সমৃদ্ধির জন্যে।

ভাবসম্প্রসারণ: পৃথিবীতে মানুষ নিরন্তর সংগ্রাম করে চলেছে কখনাে দুঃখকে অতিক্রম করার জন্যে, আবার কখনাে সুখের সন্ধানে। আমরা জানি, সুখ-দুঃখ পালাক্রমে আসে মানুষের জীবনে। একটানা দুঃখ যেমন মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে, তেমনি একটানা সুখও একঘেয়ে ও বৈচিত্র্যহীন। এ দুটো বিষয় আছে বলেই মানুষ জীবনকে যথার্থভাবে উপভােগ করতে পারছে। যেমন: রাতের পর দিন, আলাের পর অন্ধকার। রাতের ভয়ভীতি দিনের আলােয় দূর হয়, অন্ধকারের পর আলাে মনে প্রফুল্লতা সৃষ্টি করে। কাজে গতি আসে। কোনাে অন্ধকারই চিরস্থায়ী নয়, সাময়িক। তেমনি দুঃখও চিরস্থায়ী নয়। দুঃখ-যন্ত্রণায় পুড়ে যে সুখ পাওয়া যায় সেটা খাটি সুখ অর্থাৎ প্রকৃত সুখ। রাতের আঁধার শেষে একসময় প্রভাতের আলাে দেখা দেয়। এটি যেমন সত্য তেমনি জীবনে দুঃখকে দেখে হতাশ হওয়া উচিত নয়। প্রভাতের মতাে এক সময় সুখ এসে সেখানে উঁকি দেবে । এদের একটির অবস্থান অপরটির বিপরীতে। দুঃখের ভয় আছে বলেই মানুষ তাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। সাধনা করে সুখের সােনালি প্রভাতের। দুঃখের উপস্থিতিই মানুষকে সুখের মূল্য বােঝায়। তবুও অবুঝ মানুষ চিরসুখের অযৌক্তিক কামনা নিয়ে ভাবে সুখ বুঝি তার দুয়ারে এলাে না। মানুষ ভুলে যায়। যে, ‘পতঙ্গ আনন্দ বিহারে যতই উর্ধ্বগগনে উড়তে থাকে, তার পতনের মুহূর্তও ততই নিকটবর্তী হয়। দিন আবর্তিত হয় রাতকে ঘিরে, রাত দিনকে ঘিরে তাই রাত যত গভীর হয় ততই প্রভাত এগিয়ে আসে । সুখ-দুঃখ তেমনি এক রহস্য।

জীবনে দুঃখ-যন্ত্রণা দেখে কাপুরুষের মতাে মুষড়ে পড়া মােটেই কাম্য নয়। প্রকৃতির নিয়মে রাত দিনের আলােকে

গ্রাস করে চিরস্থায়ী হতে পারে না তেমনি সুখ দুঃখও কখনাে চিরস্থায়ী নয়।

মূলভাব : মানব জীবন যতই দুঃখময় হােক না কেন একপর্যায়ে গভীর অমানিশা কেটে গিয়ে দেখা দেয় প্রভাত সূর্যের রশ্মি, সুন্দর-সুখী। ও বিপদমুক্ত বাঞ্ছিত মুহূর্ত।

সম্প্রসারিত ভাব : মানব জীবন কণ্টকমুক্ত নয়। জীবন চলার পথে সুখ-দুঃখ, বিপদ-আপদ পাশাপাশি অবস্থান করে। ফলে কখনাে সুখ, আবার কখনাে দুঃখ এসে জড়িয়ে যায় জীবনের সাথে। দুঃখ ছাড়া যেমন সুখ কল্পনা করা যায় না, তেমনি জীবনে শুধু দুঃখ থাকে তাও ভাবা নিরর্থক। বেদনার শেষ সীমায় অবস্থান করে স্বাচ্ছন্দ্যিক জীবনের খেয়া। অন্ধকার রাত্রির প্রহর কেটে দেখা দেয় সােনালি উষা। তাই দুঃখের আঁধারে জীবন ঢেকে গেলেও হতাশ হওয়ার কিছু নেই। কারণ দুঃখের পর একসময় সুখ আসতে বাধ্য। রাত যত গভীর হয় ততই তা দিনের সান্নিধ্যে আসে- এটাই প্রকৃতির নিয়ম। তেমনি দুঃখ-বেদনা, বিপদ-আপদ যতই গভীর থেকে গভীরতর হয় বুঝতে হবে সুখের সােনালি প্রভাত ততই নিকটে। এ প্রসঙ্গে বার্নার্ড জোসেফ বলেছেন, “এমন কোনাে রাত নেই যার ভাের হবে না। এমন কোনাে দুঃখ নেই যা সময়ে ফিকে হয়ে আসবে না।

মন্তব্য : জীবনের পাশাপাশি মৃত্যুর আহ্বান যেমনি অমােঘ সত্য, তেমনি সুখ-দুঃখ একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িতএকটিকে বাদ দিয়ে অপরটির অস্তিত্ব কল্পনা করা মিথ্যা মরীচিকা ছাড়া আর কিছুই নয়।

যে একা সেই সামান্য। যাহার ঐক্য নাই, সেই তুচ্ছ

যে একা সেই সামান্য। যাহার ঐক্য নাই, সেই তুচ্ছ বা একতাই বল ভাবসম্প্রসারণ

মূলভাব: সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ জীব মানুষ। কিন্তু একা সে অসহায় ও নিঃসঙ্গ আর যে মানুষ জীবন চলার পথে ঐক্যবদ্ধভাবে চলে না সে শক্তিতে দুর্বল এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে অতি নগণ্য। কারণ ঐক্যই মানুষের জীবনের চলার পথের গুরুত্বপূর্ণ অবলম্বন।

ভাবসম্প্রসারণ: পৃথিবীর জন্মলগ্নে মানুষ একা ও বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করার কথা ভাবতে পারত না। তখন মানুষ ছিল খুবই অসহায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্য জীবজন্তুর আক্রমণ আর নানা সমস্যা তখন একা মােকাবিলা করা ছিল কষ্টদায়ক । ফলে ভয়ভীতি নিয়ে, এমনকি মৃত্যুর মুখােমুখি হয়ে তাদের দিনযাপন করতে হতাে। এসব নানা কারণে তখন মানুষ উপলব্ধি করল ঐক্যবদ্ধ জীবন ছাড়া তাদের পক্ষে বেঁচে থাকা অসম্ভব। তাই মানুষ নিজ প্রয়ােজনে তখন গড়ে তােলে সমাজবদ্ধ জীবন এবং হয়ে ওঠে ঐক্যবদ্ধ শক্তিতে বলীয়ান। আমরা জানি, বর্তমানেও কারাে পক্ষেই একাকী জীবনযাপন করা সম্ভব নয়। কোনাে জাতি এবং রাষ্ট্রের পক্ষেও একাকী পৃথিবীর বুকে টিকে থাকা সম্ভব নয়। পৃথিবীতে যে দেশ বা জাতি উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছেছে তারা সকলেই ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা এবং চেতনার দ্বারা তা সম্ভব করেছে। একা একজন মানুষের পক্ষে কখনাে একাকী কোনাে দুর্যোগ মােকাবিলা করা সম্ভব নয়। কিন্তু ঐক্যবদ্ধ শক্তি দ্বারা তা সম্ভব । একটি দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, অর্থনৈতিক মুক্তির জন্যে প্রয়ােজন সমগ্র দেশের জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা, দেশপ্রেম, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা। তা না হলে দেশ বা জাতি এগােতে পারে না। পৃথিবীর বহু দেশ ঐক্যহীনতার কারণে কাঙ্ক্ষিত উন্নতি অর্জন করতে পারেনি। যেমন: সােমালিয়া, বসনিয়া, ইথিওপিয়াসহ আরও অনেক দেশ। মূলত জনগণের ঐক্যের অভাব আর সুবিধাভােগী মানুষের লেজুড়বৃত্তির কারণে বহুদেশ আজ বিপর্যয়ের মুখােমুখি । অপরদিকে, বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতা এনেছে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় যদি বাংলার মানুষ দ্বিধাবিভক্ত থাকত তাহলে বাংলাদেশকে স্বাধীন করা সম্ভব হতাে না। একতাই বল’ এ মূলমন্ত্র মানুষের মধ্যে সাহস সঞ্চার করে, মানুষকে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করে, মানুষের মধ্যে অনুপ্রেরণা জোগায়, সর্বোপরি মানুষকে এক সূত্রে আবদ্ধ করে।

যে একা সে থাকে দুর্বল, আর যার ঐক্য নেই সে শক্তিহীন। ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টাই বর্তমান পৃথিবীর এ সুন্দর আধুনিক রূপ সৃষ্টি করেছে। আর পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কার মধ্যে ঐক্যই পৃথিবীকে টিকিয়ে রাখবে।

পৃথিবী অলস ভীরু কাপুরুষের জন্যে নয় ভাবসম্প্রসারণ

মূলভাব: পৃথিবীতে মানুষের জীবনটা যুদ্ধক্ষেত্রস্বরূপ। ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে সাহস ও পরিশ্রমই সৌভাগ্যের একমাত্র নিয়ামক। এখানে অলস ও ভীরু-কাপুরুষদের কোনাে ঠাঁই নেই।

ভাবসম্প্রসারণ: এ পৃথিবী এক বিশাল কর্মক্ষেত্র । যুগ যুগ ধরে তৈরি মানুষের অগ্রগতির ইতিহাস মূলত তাদের পরিশ্রম আর সাহসিকতার ইতিহাস। সাহসী মানুষেরা নিরলস শ্রমের মাধ্যমে তাদের সৌভাগ্যের ইতিহাস নিজ হাতে লিখে নিয়েছে। সে ইতিহাসে অলস ভীরু কাপুরুষদের কোনাে অবদান নেই, কোনাে স্থান নেই। কারণ জীবনে সফল হতে চাইলে বুকে সাহস ধারণ করতে হয়, পরিশ্রমী হতে হয়। পৃথিবীতে কোনাে সৌভাগ্যই আপনা-আপনি কাউকে ধরা দেয় না। বাহ্যদৃষ্টিতে মানুষ যাকে ভাগ্য বলে চিহ্নিত করে, তা মূলত মানুষের প্রাণান্ত চেষ্টা আর পরিশ্রমেরই ফসল। কর্মময় মানবজীবনে প্রতিটি কাজেই কম-বেশি ঝুঁকি থাকে। তাই বলে থেমে গেলে চলবে না, পিছিয়ে যাওয়া যাবে না । জীবনসংগ্রামে টিকে থাকতে হলে পরিশ্রমকে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করে নির্ভীকচিত্তে সামনে এগুতে হবে। মানব সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকে সাহসী মানুষেরা অন্যদের নেতৃত্ব দিয়ে আসছে, পরিশ্রমীরা সাফল্য লাভ করেছে। পৃথিবীতে যারা আজ সবার কাছে স্মরণীয়-বরণীয় বলে মান্য, তারা সবাই ছিলেন পরিশ্রমী এবং অকুতােভয় প্রাণ। পক্ষান্তরে আলস্য ও ভীরুতা জীবনে শুধু ব্যর্থতার অভিশাপই বয়ে আনে। আলস্য জীবনে এক অভিশাপ। অলস ব্যক্তির দ্বারা কোনাে কাজই ঠিকভাবে সম্পাদিত হয় না। কর্মবিমুখ ব্যক্তি অলসতার প্রশ্রয়ে যা কিছু চিন্তা-ভাবনা করে আকাশকুসুম রচনার মতােই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ভীরুরা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারে না, সকল কাজে ব্যর্থ হয়। জীবনকে তারা উপভােগ করতে পারে না, মরণের আগেই বহুবার মৃত্যুবরণ করে। সমাজ তাদের ধিক্কার জানায়, মরণের সাথে সাথে পৃথিবী থেকে তাদের নাম-নিশানা মুছে যায়। তাই জীবনকে সুচারুরূপে পরিচালনা করে পৃথিবীতে নিজের কীর্তিগাথা রচনা করতে চাইলে অবশ্যই সাহসী হতে হবে, অলসতা সম্পূর্ণভাবে পরিহার করতে হবে।

জগতের নিরন্তর কর্মযজ্ঞে ভীরু ও অলসপ্রকৃতির লােকদের কোনাে মূল্য নেই। বুকে সাহস নিয়ে পরিশ্রমের মাধ্যমে স্বীয় অস্তিত্বের জানান দিতে হবে। তবেই জীবনে অর্জিত হবে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য, পাওয়া যাবে শ্রেষ্ঠত্বের আসন।

স্বশিক্ষিত লােক মাত্রই সুশিক্ষিত ভাবসম্প্রসারণ

মূলভাব: শিক্ষার কোনাে সীমা বা পরিসীমা নেই। কেননা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে জ্ঞান অর্জন করা। আর ‘দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত শিক্ষা লাভের সময়।’ একটা শিক্ষা হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আর অন্যটি বাস্তব জীবনের প্রেক্ষিতে প্রকৃতি থেকে অর্জিত শিক্ষা।

ভাবসম্প্রসারণ: প্রতিষ্ঠান থেকে অর্জিত শিক্ষা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ হয়ে যায়। কিন্তু শিক্ষার তাে শেষ নেই। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় নির্দিষ্ট ডিগ্রি প্রদানের মধ্যেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়। এতে জ্ঞানের পূর্ণতা আসে না। সেহেতু শিক্ষার পরিধি অনেক বড়। তাই এর জন্য যথেষ্ট অনুশীলন করতে হয়, জ্ঞানচর্চা করতে হয়। অনেক জ্ঞানী শিক্ষিতজন আছেন, যারা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেও নিজের বা দেশ ও জাতির কল্যাণে কিছুই করতে পারেননি। কারণ তাঁরা স্বশিক্ষায় সুশিক্ষিত না। প্রাতিষ্ঠানিক বইপুস্তকের বাইরেও জ্ঞানচর্চার জন্য অনেক বই আছে। যেগুলাে পড়লে অনেক কিছু জানা যায়। শুধু বই কেন, পরিবার, সমাজ থেকেও শিক্ষণীয় অনেক বিষয় আছে। সেখান থেকে জ্ঞানলাভ করা যায়। অনেক স্বশিক্ষিত ব্যক্তি আছেন, যারা কোনাে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পাননি অথচ তারা এই বিশ্বমানবের কল্যাণের জন্যে অনেক কিছু করে গেছেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ সক্রেটিস, এরিস্টটল, নিউটন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখের নাম উল্লেখ করা যায়। তারা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে অমর হয়ে রয়েছেন সকলের মাঝে। সুশিক্ষিত লােক হন আলােকিত মানুষ। ঈদের থাকে পরিশীলিত রুচিবােধ। তাই একটি দেশ ও জাতির সার্বিক উন্নতির চিন্তা করলে স্বশিক্ষিত ও সুশিক্ষিত লােকের বড় বেশি প্রয়ােজন। আর একমাত্র স্বশিক্ষার মাধ্যমেই সুশিক্ষিত হয়ে ওঠা সম্ভব। সুশিক্ষিত ব্যক্তির মন হয় জ্ঞানের আলােয় উদ্ভাসিত। তাঁরা হন যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী। এঁদেরই বলা হয় আলােকিত মানুষ। আর এ আলােকিতজনরা তাদের জ্ঞানের আলাে ছড়িয়ে দেন সমাজের চারধারে। তাদের রুচিবােধ হয় উন্নত, তাঁরা অচিরণে থাকেন বিনম্র ।

একটা দেশ ও জাতির সমৃদ্ধি ও উন্নতিকল্পে স্বশিক্ষিত ও সুশিক্ষিত লােকের কোনাে বিকল্প নেই। এজন্যে নিজস্ব উদ্যোগেরও খুব প্রয়ােজন । জ্ঞানপিপাসু মানুষ তাই সারাজীবন জ্ঞান সাধনা করে চলে। জ্ঞানার্জনের কোনাে বিকল্প নেই।

স্বার্থপরতা মানবজীবনের উন্নতির পথে অন্যতম প্রতিবন্ধক

মূলভাব: মানবজীবনের সার্থকতা স্বার্থপরতার সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রে ঘুরপাক খাওয়া নয়। বরং আত্মকেন্দ্রিকতার বলয় থেকে মুক্ত হয়ে বিশাল জনসমাজের সাথে একাত্ম হওয়ার মধ্য দিয়েই জীবনে সত্যিকার সার্থকতা আসে। তাই নিজ স্বার্থচিন্তা নয়, মানবতার স্বার্থকে উচ্চে স্থান দিয়েই জীবনকে সার্থক করতে হবে।

ভাবসম্প্রসারণ: মানুষ ধরণীর বুকে শুধু নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকার জন্যে জন্মগ্রহণ করে না। সৃষ্টিরাজ্যে শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ। এ শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্যে তাকে দেওয়া হয়েছে বুদ্ধি ও বিবেকবােধ।তা দিয়ে সে মনুষ্যত্ববােধের বিকাশ ঘটায়, চিন্তা করে বৃহত্তর মানবসমাজের স্বার্থ নিয়ে। আত্মকেন্দ্রিকতার পরিবর্তে বৃহত্তর মানবতার স্বার্থচিন্তাই মানুষকে দেয় তার প্রকৃত পরিচয়। আমাদের আজকের বিশ্ব যুগ যুগ ধরে অগণিত পরহিতব্রতী মহামানবের অবদান, যারা আপন জীবনের কল্যাণচিন্তা নয়, পৃথিবীব্যাপী বিস্তৃত বিশাল মানবসমাজের কল্যাণচিন্তা করেছেন । চেষ্টা করেছেন নানামুখী মহৎ কর্ম ও সৃষ্টি দিয়ে একটা কল্যাণজনক সুন্দর পৃথিবী গড়ে তুলতে। তা কেবল তাদের কালের মানুষের কল্যাণের জন্যে নয় বরং অনাগত কালের বিশাল মানবসমাজের জন্যেও । অন্যকে আনন্দদানের মধ্যেই তারা নিজেদের জীবনের আনন্দ খুঁজে পেয়েছেন। ফলে পরের কল্যাণে জীবনােৎসর্গকারী এসব মহৎ ব্যক্তি মানবহৃদয়ে অমরত্বের আসন পান। অন্যদিকে আত্মমগ্ন মানুষ নিজেকে নিয়ে এতটাই ব্যস্ত থাকে যে পৃথিবীর বিশাল অঙ্গনে দৃষ্টি নিক্ষেপের সুযােগ সে পায় না। ফলে আপনবৃত্তে ঘুরপাক খেতে খেতেই তার জীবনাবসান ঘটে। মানবসমাজের সাথে একাত্মতা ঘােষণার যে অপার্থিব আনন্দ তা থেকে যায় তার ধরাছোঁয়ার বাইরে। এমন ধরনের মানুষ। সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হীনম্মন্য মানুষ। ব্যক্তিহৃদয়ে তার আসন সৃষ্টি তাে দূরে থাক, তার জন্যে সামান্যতম শ্রদ্ধাও সৃষ্টি হয়। আপন গণ্ডির চারপাশে প্রদক্ষিণ করতে করতে সে মানুষ হিসেবে তার স্বাভাবিক হৃদয়ধর্মও হারিয়ে ফেলে। কারাে ভালাে-মন্দ, মঙ্গল-অমঙ্গল, কল্যাণ-অকল্যাণ স্বার্থান্ধ মানুষের মনে কোনাে রেখাপাত করে না। ফলে মৃত্যুর সাথে সাথেই এদের অস্তিত্ব পৃথিবীর বুক থেকে পুরােপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। অন্যদিকে নিঃস্বার্থ পরােপকারী মানুষ কর্মের মধ্য দিয়ে আপন চৌহদ্দি পার করে বিশ্বমানবের প্রতিনিধি হয়ে ওঠেন। ফলে পৃথিবীর বুকে তিনি মহৎ মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকেন চিরকাল।

মানবজীবনের প্রকৃত সার্থকতা বৃহত্তর মানবতার কল্যাণ-চিন্তার মধ্যে নিহিত। নিঃস্বার্থ পরােপকারিতার মধ্যে জীবনের প্রকৃত আনন্দ লাভ হয়। তাই আত্মসর্বস্বতার সকল দ্বার বন্ধ করে দিয়ে বৃহত্তর মানবসমাজের কল্যাণে নিজেকে নিয়ােজিত করতে হবে, যা কিছু মানুষকে পীড়িত করে তা রােধ করতে নিজের জীবন উৎসর্গে প্রস্তুত থাকতে হবে ।

শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড » শিক্ষাই জাতির উন্নতির পূর্বশর্ত

ভাবসম্প্রসারণ: শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড / শিক্ষাই জাতির উন্নতির পূর্বশর্ত

ভাবসম্প্রসারণ: শিক্ষা ছাড়া কোনাে দেশ বা জাতি উন্নতির শিখরে আরােহণ করতে পারে না । জাতির উন্নতি ও সফলতা নির্ভর করে শিক্ষার ওপর। শিক্ষা এমনই এক শক্তি যা মানুষের অন্তরকে করে আলােকিত, বিবেককে করে জাগ্রত । এমনকি জীবন বিকাশের পথে সকল বাধা দূর করে সুন্দর সমাজ ও দেশ গঠনের পথ তৈরি করে। শিক্ষাই জাতির সামনে এগিয়ে চলার পথ তৈরি করে।

মেরুদণ্ডহীন মানুষ যেমন পঙ্গু, তেমনি শিক্ষাহীন জাতি পঙ্গু। মেরুদণ্ড যেমন মানুষকে সঠিকভাবে, সচলভাবে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে। তেমনি শিক্ষাও জাতিকে মাথা উঁচু করে দাড়াতে সাহায্য করে। মেরুদণ্ডহীন মানুষকে অন্যের গলগ্রহ হয়ে বেঁচে থাকতে হয়। তেমনি শিক্ষাহীন জাতির জীবন অচল অসাড়। কোনাে জাতিকে শক্তিশালী করার পেছনে শিক্ষার ভূমিকা প্রবল। শিক্ষাহীন জাতি অনুন্নত ও পশ্চাৎপদ অবস্থায় পড়ে থাকে। আমরা জানি, শিক্ষাই জাতির সকল উন্নতির পূর্বশর্ত। জাতিকে জ্ঞান-বিজ্ঞানে, কর্মে বিকশিত করে তুলতে হলে সবার আগে দরকার শিক্ষা। কারণ যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত সে জাতি তত বেশি উন্নত। শিক্ষার মাধ্যমে জাতি জ্ঞানের রাজ্যে বিচরণ করে দেশকে সমৃদ্ধ করার প্রচেষ্টা চালায়। শিক্ষার আলােয় মানুষের মনের কুসংস্কার, সংকীর্ণতা ও অজ্ঞানতা দূর হয়। আজকের বিশ্বে যেসব দেশ চরম উন্নতি লাভ করেছে তার মূলে আছে শিক্ষা। আমেরিকা, জাপান, ফ্রান্স, জার্মানি, ইংল্যান্ড প্রভৃতি দেশ শিক্ষার দ্বারা অজ্ঞতার অভিশাপ দূর করে উন্নতির শীর্ষে আরােহণ করেছে। সূর্যের আলাে যেমন অন্ধকারের হাত থেকে পৃথিবীকে মুক্ত করে, তেমনি শিক্ষার আলাে মানবজীবনকে, দেশকে, জাতিকে করে উদ্ভাসিত ও আলােকিত।

শিক্ষার মাধ্যমেই মানুষ মনুষ্যত্ব লাভ করে। পৃথিবীর বুকে স্বগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শিক্ষাই যথার্থ ভূমিকা পালন করে। শিক্ষার মাধ্যমেই জাতির মেরুদণ্ড শক্ত হয়, জাতি এগিয়ে চলে উন্নতির পথে।

শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড ভাবসম্প্রসারণ এর ভিন্ন প্রতিলিপন

মূলভাব : মেরুদন্ড যেমন মানবদেহের অপরিহার্য অঙ্গ তেমনি জাতির অস্তিত্বের প্রশ্নে শিক্ষা অত্যাবশ্যকীয়।

সম্প্রসারিত ভাব : মেরুদণ্ড হলাে শিরপাড়া। মেরুদণ্ড শরীরকে সােজা রাখে। মানুষ যদি মেরুদণ্ডবিহীন হতাে তবেচলাফেরা করা তাে দূরের কথা, সােজা হয়ে দাঁড়ানােই অসম্ভব হতাে। তখন তাকে হামাগুড়ি দিয়ে পশুর মতাে চলতে হতাে,হয় জড় পদার্থের মতাে পড়ে থাকতে হতাে। এ অবস্থায় তার পক্ষে বেঁচে থাকার কোনাে গুরুত্বই থাকত না। তেমনিভাবে আমাদের ব্যক্তিজীবন থেকে জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। মেরুদণ্ড ছাড়া মানুষকে যেমন মানুষ হিসেবে কল্পনা করা যায় না, শিক্ষা ছাড়াও কোনাে জাতিকে সভ্য জাতি হিসেবে কল্পনা করা যায় না। যে কোনাে সভ্য জাতির মেরুদণ্ড হলাে শিক্ষা। কোনাে জাতির উন্নতি ও সফলতা নির্ভর করে তার শিক্ষার উপর। যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত সে জাতি তত বেশি উন্নত। যেখানে শিক্ষা নেই, সেখানে জন্ম নেয় যাবতীয় কুসংস্কার এবং সেখানে জীবনের কোনাে অগ্রগতি হয় না। জাতীয় অগ্রগতি হয়ে পড়ে পঙ্গু ও স্থবির।

মন্তব্য : কোনাে জাতিকে জাতি হিসেবে টিকে থাকতে হলে প্রয়ােজন শিক্ষার। শিক্ষা ব্যতীত কোনাে জাতির উন্নতির আশা দুরাশার শামিল।

আত্মশক্তি বা জ্ঞানশক্তি অর্জনই শিক্ষার উদ্দেশ্য

আত্মশক্তি অর্জনই শিক্ষার উদ্দেশ্য ভাবসম্প্রসারণ

মূলভাব: আত্মশক্তি বা জ্ঞানশক্তি মানুষের একটি বিশেষ গুণ, যা তার অস্তিত্বের মাঝেই নিহিত থাকে। কিন্তু মানুষ জন্মগতভাবে এ শক্তির অধিকারী হয় না। মানুষের মধ্যে আত্মশক্তি বা জ্ঞানশক্তি তখনই জাগ্রত হয় যখন মানুষের মন প্রকৃত শিক্ষার আলােকে আলােকিত হয়। বস্তুত শিক্ষার মূল লক্ষ্য মানুষের আত্মশক্তি বা জ্ঞানশক্তির বিকাশের মাধ্যমে তার মনুষ্যত্ব ও বিবেককে জাগ্রত করা।

ভাবসম্প্রসারণঃ শিক্ষা প্রত্যেক মানুষের মৌলিক অধিকার। শিক্ষা মানুষকে নিজেকে জানতে ও চিনতে শেখায়। প্রকৃত শিক্ষা মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ববােধ জাগ্রত করে, তার ভেতরের সুপ্ত প্রতিভাকে জাগিয়ে তােলে। যে শিক্ষা শুধু খেয়ে-পরে বা ভােগবিলাসে জীবন কাটাতে বা বাঁচতে শেখায় তা কখনাে প্রকৃত শিক্ষা হতে পারে না। যে শিক্ষা জীবনকে সকলের সঙ্গে উপভােগ করতে এবং কল্যাণমুখী কাজে লাগাতে শেখায় না সেটি প্রকৃত শিক্ষা নয়। এ ধরনের শিক্ষা জীবনে সােনা ফলাতে পারে না। শিক্ষা। মানুষকে শেখায় ‘লােভে পাপ, পাপে মৃত্যু। অনেকের মতে, ‘শিক্ষা মনের একটি চোখ। তাই মানুষের মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটে শিক্ষার মাধ্যমে। শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ তার মানবিক গুণগুলাে অর্জন করে। শিক্ষার আলাে না হলে মানুষ আর পশুর মধ্যে কোনাে পার্থক্য থাকত না। আত্মশক্তিতে বলীয়ান মানুষই কর্তব্যপরায়ণ, বিবেকবােধ সম্পন্ন, সমব্যথী, সর্বোপরি সকল মানবিক গুণের অধিকারী। জ্ঞানশক্তি বা আত্মশক্তি না থাকলে মানুষ শিক্ষিত হয়েও কখনাে যথার্থ মানুষ হতে পারে না! ডিগ্রি বা সনদের কোনাে মূল্যই থাকে না যদি শিক্ষিত ব্যক্তি আত্মশক্তি ও জ্ঞানশক্তি অর্জন না করে। প্রতিটি মানুষ অফুরন্ত সম্ভাবনার খনি, সে কী হতে পারে তা সে নিজে জানে না, আর এ অজ্ঞতাই তার উন্নতির পথে বাধা। শিক্ষা মানুষের ভেতরে প্রতিভার আলাে জ্বালিয়ে অজ্ঞতাকে দূর করে তাকে আত্মশক্তিতে বলীয়ান করে, সত্যিকার মানুষ হিসেবে গড়ে তােলে। মানুষ জ্ঞান আহরণ করলে অর্জন করে আত্মশক্তি, আর জ্ঞান নামক এ শক্তি হৃদয়ের লুকানাে সকল গুণকে শক্তিশালী করে।

শিক্ষার মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন করে মানুষ হয়ে ওঠে আত্মশক্তিতে বলীয়ান। তাই শিক্ষার উদ্দেশ্য সনদ অর্জন করে চাকরি করে। বিলাসী জীবনযাপন নয়। নিজেকে জানা, বােঝা, আবিষ্কার করা ও শক্তিশালী করাই শিক্ষার উদ্দেশ্য।

একই ভাবসম্প্রসারণের ভিন্ন প্রতিলিপন

মূলভাব : আত্মশক্তি মানুষের একটি মহৎ গুণ। এর অভাবে মানুষ পরনির্ভরশীল হয়ে পড়ে। আর শিক্ষা মানুষকেআত্মশক্তিতে বলীয়ান করে তােলে।

সম্প্রসারিত ভাব : আত্মশক্তি মানুষের মহৎ গুণগুলাের মধ্যে অন্যতম। আত্মশক্তির বলে বলীয়ান মানুষ নিজের শক্তিরওপর নির্ভরশীল হয়ে স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশ করতে ও কাজকর্ম করতে পারে। আত্মশক্তি না থাকলে মানুষ নিজের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। তখন সামান্য কাজেও তাকে অন্যের সাহায্যের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। সব কিছুতেই তাদের যেনসংশয় কাজ করে। অন্যদিকে শিক্ষার আলােয় আলােকিত ব্যক্তিদের দৃষ্টি বহুদূর প্রসারিত থাকে। তাদেরকে জীবনের বিভিন্ন ।সমস্যা সমাধানের জন্য পরমুখাপেক্ষী হতে হয় না। নিজের শক্তিকেই তারা সবচেয়ে বড় হাতিয়ার মনে করে। আর এ সবকিছুই সম্ভব প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আত্মশক্তি অর্জনের মাধ্যমে। কিন্তু এ আত্মশক্তি মানুষের মধ্যে সুপ্ত অবস্থায় বিরাজকরে। তাকে সঠিকভাবে সঠিক সময়ে আবিষ্কার করে নিতে হয়। যারা উপযুক্ত শিক্ষা অর্জন করে, তারা তা পারে। আর যারামূৰ্থ তারা তার সন্ধান পায় না। পরনির্ভরশীল না হয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করার জন্য মানুষ শিক্ষা অর্জন করে থাকে। শিক্ষাতাকে কাজের যােগ্য করে তােলে এবং যােগ্যতা থাকলে সে দৃঢ় মনােবলের অধিকারী হয়। হাদিসে আছে, ‘যে শিক্ষা গ্রহণ করে তার মৃত্যু নেই।’

মন্তব্য : শিক্ষা মানুষকে যে কোনাে ভালাে ও সৎকর্মের যােগ্য করে তােলে। এর জন্য সর্বাগ্রে যে জিনিসটি প্রয়ােজন তাহলাে দৃঢ় মনােবল আর সুকঠিন একাগ্রতা।

চরিত্র মানুষের অমূল্য সম্পদ / চরিত্রহীন মানুষ পশুর সমান / চরিত্র মানবজীবনের মুকুটস্বরূপ ভাবসম্প্রসারণ

মূলভাব: চরিত্র মানবজীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। চরিত্র যেমন অমূল্য সম্পদ তেমন মহামূল্যবান মুকুটম্বরূপ । তাই চারিত্রিক গুণই মানুষকে সত্যিকারের মানুষ করে তােলে, মহৎ করে এবং অমর করে রাখে।

ভাবসম্প্রসারণ: মানবজীবনের উন্নতি, সফলতা ও সার্থকতা বিকাশের জন্য চরিত্রের গুরুত্ব অপরিসীম। চরিত্রবান ব্যক্তি সত্য ও ন্যায়ের অনুসারী। এ ধরনের মানুষ জাগতিক লােভ-লালসা ও মিথ্যা প্রলােভনে কখনাে প্রলুব্ধ হয় না।এরা আপস করে না অন্যায়ের সাথে। এরা সূর্যের মতাে প্রখর, পর্বতের মতাে অচল এবং প্রয়ােজনে বরফের মতাে বিগলিত। চরিত্রবান মানুষ সবার শ্রদ্ধার পাত্র। চরিত্রবান মানুষের সংস্পর্শে এলে যেকোনাে মানুষ সত্য ও সুন্দর পথের সন্ধান পায়। অপরদিকে, দুশ্চরিত্র ব্যক্তি সমাজ, দেশ ও জাতির জন্যে অকল্যাণকর। গাড়ি-বাড়ি, ধন-দৌলত, শিক্ষা-দীক্ষা ও সম্মান সবকিছুই মূল্যহীন হয়ে পড়ে যদি কোনাে লােক চরিত্রহীন হয়। চরিত্রহীন ব্যক্তি তার লােভলালসা ও হিংসা-দ্বেষ দিয়ে সমাজ ও দেশকে কলুষিত করে। তারা সামাজিকভাবে পশুর চেয়ে অধম বলে বিবেচিত হয়। তাদের কোনাে মর্যাদা থাকে না। চরিত্রবান ব্যক্তি তার মনুষ্যত্ব ও বিবেক দিয়ে দেশ ও জাতির কল্যাণের জন্যে কাজ করে। পক্ষান্তরে, চরিত্রহীন ব্যক্তি বিষধর সাপের মতাে ভয়ংকর। এ ধরনের ব্যক্তিরা প্রয়ােজনে যেকোনাে ভয়ংকর কাজ করতে দ্বিধা করে না। তাই প্রত্যেক মানুষকে জীবনে সফলতার জন্যে দেশ ও জাতির কল্যাণের জন্যে সাধনার মাধ্যমে উত্তম চরিত্র গঠন করতে হবে। জগৎ-সংসারের সকল জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি তাঁদের মহৎ চরিত্রের জন্যেই স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন। তাঁদের উত্তম চরিত্র সকলের আদর্শ। কথায় বলে, সম্পদ হারিয়ে গেলে কখনাে কখনাে পুনরুদ্ধার করা যায়, কিন্তু চরিত্র হারালে তা আর ফিরে পাওয়া যায় না।

চরিত্রবান ব্যক্তি যেমন নিজ জীবনকে আলােকিত ও সুন্দর করে তেমনি সমাজ, দেশ ও জাতিকে আলােকিত করে। তাই কোনাে জাতিকে উন্নত করতে হলে অবশ্যই উন্নত চরিত্রের জাতি গঠন করতে হবে।

একই ভাবসম্প্রসারণের ভিন্ন প্রতিলিপন

মূলভাব : মানুষের সব সম্পদের মধ্যে চরিত্রই বড় সম্পদ। উত্তম চরিত্রের লােক সর্বত্র সম্মান পেয়ে থাকে। পক্ষান্তরে,চরিত্রহীন ব্যক্তি অজস্র ধন সম্পদের অধিকারী হলেও সকলের ঘৃণার পাত্র।

সম্প্রসারিত ভাব : ইংরেজিতে একটি কথা আছে-“The crown and glory of life is character.” চরিত্রমানবের মহার্ঘতম বস্তু, শ্রেষ্ঠতম অলংকার। হাদিসে আছে, “সবচাইতে পূর্ণ ঈমানদার সেই ব্যক্তি যার আখলাক অর্থাৎ চরিত্র।সবচেয়ে ভালাে।” চরিত্র সম্পদ অন্য সকল সম্পদ অপেক্ষা অধিক মূল্যবান। চরিত্র গৌরবে বলীয়ান মানুষ দেবতার মহিমায়পৃথিবীতে বিরাজ করে। চরিত্র মানুষকে ন্যায়, সত্য, সংযম ও শ্রদ্ধাবােধ শিক্ষা দেয় এবং সৎপথে চলতে উদ্বুদ্ধ করে। চরিত্রবান ব্যক্তি সমাজের শিখাস্বরূপ। সে অর্থসম্পদে দীন হলেও গৌরবে মহান। কথায় আছে, “রাজার জোর অর্থের আর চরিত্রবান ব্যক্তির জোর হৃদয়ের। হৃদয়িক মহিমায় উজ্জ্বল চরিত্রবান ব্যক্তি সদালাপী, বিনয়ী ও জ্ঞানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন। চরিত্রবান ব্যক্তি মহাপুরুষরূপে সমাজে সমাদৃত। পক্ষান্তরে, চরিত্রহীন ব্যক্তি পশুর সদৃশ। সে গন্ধহীন পুষ্পের মতাে। তাই কেউ তাকে সম্মান করে না। কথায় আছে- টাকা কড়ি হারালে কিছুই হারায় না, স্বাস্থ্য হারালে কিছু হারায়; কিন্তু চরিত্র।

হারালে সব কিছুই হারাতে হয়। সুতরাং সমৃদ্ধিময় জীবনের জন্য চরিত্র প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। চরিত্রের মাধ্যমেই ঘােষিত হয় জীবনের গৌরব।

মন্তব্য : মানুষের প্রকৃত পরিচয় তার চরিত্রে। চরিত্রবলেই মানুষ সুন্দর ও সার্থক হয়ে ওঠে।

ধনের মানুষ নয়, মনের মানুষ বড় বা ধনের মানুষ অপেক্ষা মনের মানুষই বড় ভাবসম্প্রসারণ

মূলভাব: প্রচলিত ধারণা অনুসারে যার ধনসম্পদ বেশি, সে বড়াে বলে বিবেচিত। অর্থসম্পদ মানুষকে সমৃদ্ধ জীবনযাপন করতে সাহায্য করে, নিজেকে বড়াে বলে ভাবার সুযােগ তৈরি করে দেয়। কিন্তু অর্থসম্পদ বেশি হলেই যে কেউ বড়াে বলে বিবেচিত হবে, তা নয়। যার মন বড়াে অর্থাৎ যিনি উদার, পরােপকারী, সৎ, তিনিই যথার্থ বড় মাপের মানুষ ।

ভাবসম্প্রসারণ: পার্থিব জীবনে জীবনধারণের জন্যে সম্পদের প্রয়ােজন সকলেরই। বিশেষ করে সাংসারিক জীবনে অর্থের প্রয়ােজন অনেক বেশি। কিন্তু অর্থ দিয়ে মন ক্রয় করা যায় না। স্নেহ, ভালােবাসা, মমতা, সেবা, পরােপকার ইত্যাদি টাকাপয়সার অনেক ওপরে। বড় মনের মানুষ অনেক মহৎ। ধনের মানুষ আর মনের মানুষের মধ্যে বিস্তর তফাত রয়েছে। ধনের মানুষকে অনেকে নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য তােষামােদ করে। ধনের মানুষ নিজেকে নিজে বড়াে বলে জাহির করে। এ ধরনের মানুষ মরে যাওয়ার সাথে সাথে পৃথিবী থেকে তাদের নাম মুছে যায়। পক্ষান্তরে, যে ব্যক্তি জ্ঞানী, পরােপকারী, চরিত্রবান ও মহৎ হৃদয়ের অধিকারী তাঁর ধনসম্পদ না থাকলেও মানুষ তাকে শ্রদ্ধা করে, ভালােবাসে। এ ধরনের মানুষ কোনাে কিছু প্রত্যাশা করেন না। তাই মরে গিয়েও এঁরা অমর হয়ে থাকেন। পৃথিবীর অনেক মহৎ ব্যক্তি আজও স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন তাঁদের মহৎ গুণের জন্যে। এঁদের অনেকেই অঢেল বিত্ত-বৈভবের অধিকারী ছিলেন না। কিন্তু ছিলেন উদার, মহৎ ও পরােপকারী মানুষ। এ গুণই তাদের বড়াে মানুষে পরিণত করেছে। ধনবান ব্যক্তিকে মানুষ শ্রদ্ধা করে স্বার্থের জন্য, কিন্তু হৃদয়বান মানুষকে শ্রদ্ধা করে ভালােবেসে। তাই হৃদয়বান মানুষ চিরদিন। মানুষের মনে অমর হয়ে থাকেন।

ভাবসম্প্রসারণ: কীর্তিমানের মৃত্যু নেই বা মানুষ বাঁচে তার কর্মের মধ্যে, বয়সের মধ্যে নয়

মূলভাব: কাজই মানুষকে পৃথিবীর বুকে বাঁচিয়ে রাখে, কীর্তিমান এবং চিরস্মরণীয় করে। অধিক বয়স কখনাে। মানুষকে চিরস্মরণীয় করার মাপকাঠি নয়। মহৎ মানুষ পৃথিবী থেকে দৈহিকভাবে মৃত্যুবরণ করলেও পেছনে থেকে যায় তার। মহৎ কর্ম। আর এ মহৎ কমই সাক্ষ্য দেয় মানুষের কীর্তি ও গৌরবের।

সম্প্রসারিত ভাব: মানুষের জীবনকে বয়সের সীমারেখা দিয়ে পরিমাপ করা যায় না। দীর্ঘজীবী হয়েও মানুষ যদি জীবনে কোনাে ভালাে কাজ না করে তবে সে জীবন অর্থহীন। এ অর্থহীন জীবন নিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার পর বেশিদিন তাকে মানুষ স্মরণ করে না। এ জীবন নীরবে ঝরে যায় । কিন্তু যে মানুষ তার ছােট্ট জীবনকে দেশ, জাতি ও সমগ্র পৃথিবীর কল্যাণে কাজে লাগায় তার জীবন হয় সার্থক। এ সার্থক জীবন অনেক সময় তার মহৎ কর্মের জন্যে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়। তাকে মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। এ অবদান বা গৌরব বয়সের সীমারেখা দ্বারা পরিমাপ করা যায় না। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও কবি সুকান্ত বয়স নয় বরং কর্মের মহৎ গুণেই অমরত্ব লাভ করেছেন। কাজী নজরুল ইসলাম অনেক বয়স পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। কিন্তু তার ৪০ বছর বয়সের পর বাকশক্তি ছিল না। কিন্তু তিনি তাঁর কর্মময় জীবনে যে সময়টুকু মহৎ সাহিত্য সাধনায় ব্যয় করেছেন, সেই মহৎ কাজের জন্যে তিনি গৌরবান্বিত হয়েছেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে নজরুল শুকতারার মতাে উজ্জ্বল হয়ে আছেন বয়সের জন্যে নয়, তার অসাধারণ সাহিত্যকর্মের জন্যে। অপরদিকে, কবি সুকান্ত মাত্র একুশ বছর বয়সে মারা যান। কিন্তু এত অল্পসময়ে তিনি বাংলা সাহিত্যে যে অবদান রেখে গেছেন তাতে তার কখনাে মৃত্যু হবে না। তিনি চিরস্মরণীয় । এমনই অনেক জ্ঞানী-গুণী দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক অসংখ্য অবদান রেখে গেছেন বিভিন্ন ক্ষেত্রে। তারা কখনাে হারিয়ে যাবেন না। পৃথিবীর বুকে তাঁরা তাঁদের মহৎ কর্মের জন্যে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকবেন।

মানুষ বেশি বয়স পর্যন্ত বাঁচলেও সেই সময়টুকু যদি কোনাে মহৎ কাজে না লাগায় তবে তার কোনাে স্থায়ী মূল্য নেই। কাজেই বয়স নয়, মহৎ কর্ম মানুষকে কীর্তিমান করে। বয়স মানুষকে তাড়িয়ে বেড়ায়। আর কর্ম মানুষকে দেয় অনুপ্রেরণা। কর্ম মানুষকে তার মৃত্যুর পরও অন্যদের কাছে বাঁচিয়ে রাখে।

একই ভাবসম্প্রসারণের ভিন্ন প্রতিলিপন

মূলভাব : কেবল দীর্ঘ জীবনের মধ্যেই মানুষ অ মগঞ্জ | ঝতে পারে না; বরং, মহৎ, কাকলির জলই কিছু মানুষজগতে চির অমর হয়।

সম্প্রসারিত ভাব : ইংরেজিতে একটি কথা আছে , Matt does not live in years but if (dead. মানুষেরকর্মজীবন স্বল্পস্থায়ী হতে পারে, হতে পারে দীর্ঘস্থায়ী। জীবদার ব্যাপ্তিকাগ দিয়ে মানুষের মূল্যায়ন করা হয় না । মানুষেরপ্রকৃত মূল্যায়ন হয় তার কর্ম দ্বারা। বয়স বেশি হলেই বাঁচা খিষ্য হয় না। বরং, কারা অমােঘ মৃত্যুর কথা খেলে কিন্তুজীবনে মানব কল্যাণে সুকীর্তির স্বাক্ষর রেখে যান, তাঁরা মরে গিয়েও চিরকাল মানুষের হৃদয়ে অমর হয়ে থাকেন মানুষ তাঁদের সুকীর্তির কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে মাথা নোয়ায়। দৈহিক মৃত্যু ঘটলেও মানুষের মাঝে তাঁরা বেঁচে থাকেন। এমন লােকের সত্যিই মৃত্যু নেই। পৃথিবীর স্মরণীয় ও বরণীয় ব্যক্তিগণ শুধু তাদের কর্মের মাধ্যমেই আমাদের মধ্যে অমর, অক্ষয় ও শ্রদ্ধাভাজন হয়ে আছেন। পৃথিবীতে বহু লােক অল্প বয়সে মৃত্যুবরণ করেও তাদের কর্মের জন্য অমর হয়ে আছেন। আবার কেউ দীর্ঘায়ু পেলেও তাদের নাম পরিচয় মিশে গেছে কালস্রোতে। বালক ক্ষুদিরাম দেশের জন্য প্ৰাণ দিয়ে অমর হয়েছেন।বরকত, সালাম, রফিক, জব্বার বাংলা ভাষা আদায়ে অকালে মৃত্যুবরণ করলেও বাংলার মানুষ কোনােদিন তাদেরকে ভুলবেনা । মাত্র একুশ বছর বেঁচে থেকে প্রতিভাবান কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য আমাদের মাঝে অমর হয়ে আছেন। কমই তাঁদেরকে বাঁচিয়ে রেখেছে, বয়স নয়।

মন্তব্য : বিশ্বজগতে অনন্ত কালপ্রবাহে মানুষের জীবন নিতান্তই ক্ষণস্থায়ী। এ ক্ষণস্থায়ী জীবন মহিমা পেতে পারে মানুষের মহৎ কর্মে ও অবদানে। তখন মৃত্যুর পরও মানুষ স্মরণীয় হয়ে থাকে। তাই বয়স মানুষের জীবনের সার্ধকতর মাপকাঠি নয়, মহৎ কীর্তির মাধ্যমেই মানুষের জীবন সফল ও সার্থক হয়।

লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু ভাবসম্প্রসারণ

মূলভাব: লোভে মানবচরিত্রে মহৎ গুণের বিকাশ সাধনের পথে অন্তরায়। লোভে এমনই এক প্রবৃত্তি যার কারণে মানুষের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। লোভে মানুষকে অন্ধ করে। জীবনের সর্বনাশ করে।

ভাবসম্প্রসারণ: আমাদের চারপাশে সর্বত্র রয়েছে লােভের হাতছানি। মানুষের মনে রয়েছে অর্থ, বিত্ত, খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠার প্রতি প্রচণ্ড লােভ। লােভী মানুষ কখনাে পরিণামের কথা চিন্তা করে না । লােভের মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে প্রিয়জনকে অবজ্ঞা করে । প্রিয়জনের আদেশ-উপদেশকে সে তখন গ্রাহ্য করে না। লােভের মােহে সে এতই আচ্ছন্ন হয়ে ওঠে যে, তখন সে মানসম্মান, জীবনের করুণ পরিণতি কোনাে কিছু সম্পর্কেই ভাবতে চায় না । পরিণামে জীবনের করুণ পরিণতি ঘটে। তাই লােভ মানবজীবনের পরম শত্রু।

লােভ মানুষকে পথভ্রষ্ট করে। অন্যায় ও অসুন্দর পথে নিয়ে যায়। তাই বিবেকবান মানুষ জীবনকে সুন্দর ও পবিত্র রাখার জন্যে লোভকে জয় করে নিজেকে রক্ষা করে। অন্যায় ও অবৈধ পথ পরিহার করে বিবেকবান মানুষ সৎ ও সুন্দর পথে এগিয়ে জীবনকে করে উন্নত। আর লােভী মানুষ অন্যায় ও অবৈধ পথে জড়িয়ে পড়ে জীবনকে করে ধ্বংস, ভালাে-মন্দ, পাপ-পুণ্য বিচারের ক্ষমতাকে করে নির্মূল । লােভী মানুষ অনেক সময় নিজের কর্মকাণ্ডের ওপর নিয়ন্ত্রণও রাখতে পারে না। পরিণামে লােভী মানুষ সর্বনাশ ও ধ্বংসের সাগরে নিমজ্জিত হয়। লােভী মানুষের অপকর্মের জন্যে অনেক সময় সুন্দর সংসারও ধ্বংস হয়ে যায়। আর সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে লােভী মানুষ অস্থিরতা সৃষ্টি করে। সেই কারণে মহান ব্যক্তি ও ধর্ম প্রচারকগণ মানুষকে লােভ দমন করার জন্যে নানা উপদেশবাণী প্রচার করে গেছেন।

জীবনকে সুন্দর, সার্থক ও অর্থবহ করতে হলে লোভেকে বর্জন করতে হবে। প্রকৃত সুখ লাভ করতে এবং মানুষের শ্রদ্ধা ও ভক্তি অর্জনের জন্যে আমাদের সকলেরই উচিত নির্লোভ হওয়া। তবেই জীবন হবে আনন্দমুখর, নির্মল ও সুন্দর।

তুমি অধম, তাই বলিয়া আমি উত্তম না হইব কেন ভাবসম্প্রসারণ

মূলভাব: মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। মানুষের রয়েছে বিবেক ও মনুষ্যত্ববােধ। যার দ্বারা মানুষ নিজের ওপর অধমের সকল কুপ্রভাব ঝেড়ে ফেলে দিয়ে নিজেকে উত্তমে পরিণত করতে পারে। কারণ মনুষ্য জাতির আদর্শই হচ্ছে উত্তম পন্থা,কোনাে অধম বা খারাপ পন্থা নয়।

ভাবসম্প্রসারণঃ পৃথিবীতে মানবজীবন প্রতিনিয়ত ভালাে ও মন্দের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়। আবার প্রতিটি মানুষের চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও মানসিকতার মধ্যে রয়েছে অভিন্নতা। তাই মানুষের মধ্যে ভালাে ও মন্দ দু ধরনের মানুষ আছে। ভালাে মানুষ অপরের মন্দ কর্মকে কখনাে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে না। অন্যায় পথের কোনাে মােহ এদেরকে আকৃষ্ট করতে পারে না। নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী এরা অন্যের কল্যাণ সাধনের চেষ্টা করে। অনেক সময় উত্তমের ব্যবহার ও আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে অধমও উত্তম হয়ে ওঠে। উত্তম ব্যক্তি বিবেক ও মনুষ্যত্ব দ্বারা দেশ ও জাতির কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করে। তাই মানুষকে চারদিকের অন্যায়-অবিচার থেকে নিজেকে রক্ষা করে মানবিক গুণে সমৃদ্ধ করতে হবে জীবনকে। প্রকৃত উত্তম ব্যক্তিকে অন্যায়, অসত্য ও অসুন্দর কখনাে আকৃষ্ট করতে পারে না। উত্তম ব্যক্তি আত্মশক্তিতে বলীয়ান থাকে। আর অধম মানসিকভাবে দুর্বল থাকে। অধম উত্তম ব্যক্তির ক্ষতি করলেও সে কখনাে তার প্রতিদানে ক্ষতি করে না। উত্তম ব্যক্তির চরিত্রগুণ, আদর্শ ও সুন্দর ব্যবহার সকলেরই আদর্শ।

প্রতিটি মানুষের জীবনের ব্রত হওয়া উচিত উত্তম সাধনা। উত্তম ব্যক্তি তার মহৎ গুণাবলি দিয়ে অধমকেও জয় করতে পারে। পারে মনুষ্যত্ব দ্বারা সকল অন্যায়কে পরাভূত করতে।

পাপীকে নয়, পাপকে ঘৃণা করো ভাবসম্প্রসারণ

মূলভাব: কোনাে মানুষই পাপী হয়ে জন্মায় না। প্রতিকূল পরিবেশে পাপ মানুষকে কলুষিত ও কলঙ্কিত করে তােলে। সুতরাং, পাপী বলে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা যায় না, কেননা সে স্বেচ্ছায় পাপী হয়নি। তাই পাপীকে নয়, তার পাপী হয়ে ওঠার কারণ তথা পাপকে ঘৃণা করা উচিত।

ভাবসম্প্রসারণ: প্রতিটি মানুষই সুখী, নির্বিঘ্ন জীবন অতিবাহিত করতে চায়, কিন্তু সবসময় সৎ জীবনযাপন করা সবার পক্ষে সম্ভবপর হয়ে ওঠে । নিয়তির খেলায় জীবনধারণের জন্যে অনেক মানুষকে অনিচ্ছাসত্ত্বেও অসৎ পন্থা বেছে নিতে হয়। সে জড়িয়ে পড়ে অন্যায় কাজে, অসৎ কাজে। আবার দেখা যায়, যে মানুষ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখে সেও নানা কারণবশত নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। জড়িয়ে পড়ে পাশবিক ও অমানবিক কাজে। তখন সে চিহ্নিত হয় পাপী হিসেবে। অথচ এরা কেউ জন্মগতভাবে পাপী ছিল না। কখনাে নােংরা পরিবেশ, প্রতিকূল সমাজের বিষাক্ত আবহাওয়া, দুর্জনের সাহচর্য অথবা অভিভাবকের তত্ত্বাবধানের জুটি মানুষকে অসৎ পথে ঠেলে দেয়। আবার অনেক সময় ভালাে মানুষও রাগে, ক্ষোভে, দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে পাপ নামক জঘন্য কাজে জড়িয়ে পড়ে। এ ধরনের মানুষরা পরে অনুশােচনার আগুনে দগ্ধ হয়। এদেরকে পাপী ভেবে, পাপের কারণ অনুসন্ধান করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। শুধু পাপী ভেবে শাস্তি দিলে পাপের মাত্রা আরও বেড়ে যাবে। এমনকি ফলাফল ভয়ংকরও হতে পারে। আবার পাপীকে তার পাপ কর্মের জন্যে ঘৃণা না করলে অনেক সময় পাপের মাত্রা সমাজে আরও বেড়ে যেতে থাকে। তাই মানবিক দৃষ্টিকোণ দিয়ে সমাজ ও দেশের কথা ভেবে, সর্বোপরি সূক্ষ্মভাবে বিচারবিশ্লেষণ করে পাপীর পাপ কাজের বিচার করা উচিত। অনেক পাপী তার পাপ কাজের জন্যে অনুশােচনায় দগ্ধীভূত হয়, আবার অনেকের মধ্যে লেশমাত্র অনুতপ্ত ভাব দেখা যায় না।

পাপী এবং পাপের মূল্যায়ন আমাদের সঠিকভাবে করা উচিত। পাপীকে ঘৃণা না করে তার প্রতি যদি সহানুভূতি দেখানাে হয় এবং ভুল সংশােধনের সুযােগ দেওয়া হয় এবং সমাজ থেকে অপরাধের উৎস নির্মূল করা যায় তাহলে সমাজে অপরাধীদের সংখ্যা কমে আসবে।

একই ভাবসম্প্রসারণের ভিন্ন প্রতিলিপন

মূলভাব : ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ মানুষ কখনও ঘৃণাহ হতে পারে না, বরং তার দুষ্ট কর্মকেই আমাদের ঘৃণা করা উচিত।

সম্প্রসারিত ভাব : মানুষ নিস্পাপ পৃথিবীতে আসে। ধীরে ধীরে সে বড় হয়। তার চাহিদার বিস্তৃতি ঘটে। কিন্তু অনেক সময়ই তার চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি হয়। না চাইতেই যে পায় সে হয়তাে এ সংঘাতকে এড়াতে পারে। কিন্তু যেশিশু জন্মের পর থেকে বা পরবর্তীতে বিরূপ পরিবেশে বড় হয়, দুঃখ-কষ্ট, ক্ষুধা আর নির্যাতনের সাথে যার বাস, জীবনের প্রয়ােজনে তার পক্ষে সমাজের নিষিদ্ধ পথে, পাপের পঙ্কিল পথে পা বাড়ানাে অস্বাভাবিক নয়। বাধ্য হয়েই সে পাপী হয় ।কিন্তু জন্মের সময় তাে সে পাপী ছিল না। বরং পরিবেশের প্রতিকূলতাই তাকে পাপী করেছে। অনুকূল পরিবেশ পেলে, একটু স্নেহ-ভালােবাসার পরশ পেলে হয়তােবা তার হৃদয়ে সৃষ্টি হতে পারে অনুতাপের অমিয় ধারা। হয়তােবা সেই অমিয় ধারায় স্নান করে সে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে একসময়। এভাবে সমাজের বন্ধুর পথে চলতে গিয়ে বিপথগামী হওয়া ব্যক্তিদের সুপথে ফিরিয়ে এনে সমাজকে কলুষমুক্ত করা অসম্ভব কোনাে কাজ নয়। শত খুনের নায়ক ইতিহাসখ্যাত হযরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া বা উন্মুক্ত তরবারি হাতে নবিজি (স)-কে হত্যা করতে যাওয়া ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা উমর (রা.) তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কিন্তু পাপীকে ঘৃণা করে সমাজকে কলুষমুক্ত করা সম্ভব নয়। আর তাই মায়ের ঘৃণা সন্তানের বিরুদ্ধে নয়, সন্তানের গায়ে মাখা মলের বিরুদ্ধে সাবানের জেহাদ কাপড়ের বিরুদ্ধে নয়, ময়লার বিরুদ্ধে।

মন্তব্য : অপরাধীকে ঘৃণা না করে তার পুনর্বাসনে এগিয়ে এলে সমাজে অপরাধীর সংখ্যা হ্রাস পাবে। তাই আমাদেরসকলের উচিত পাপীকে নয়, পাপকে ঘৃণা করে পাপীকে পাপমুক্ত হতে সহায়তা করা।

প্রাণ থাকলেই প্রাণী হয় কিন্তু মন না থাকলে মানুষ হয় না ভাবসম্প্রসারণ

মূলভাব: মানুষকে বলা হয় সৃষ্টির সেরা জীব। কেননা তারা নিজগুণে অন্যান্য প্রাণী হতে অনেক আলাদা। মানুষের সাথে অন্য প্রাণীর পার্থক্য এখানে যে মানুষের একটি সুন্দর মন আছে। এ মনই মানুষকে মনুষ্যত্বে বলীয়ান করেছে। দিয়েছে পৃথিবীজুড়ে শ্রেষ্ঠত্ব। সেই কারণে বলা হয় পৃথিবীতে যাদের প্রাণ আছে তারা সকলেই প্রাণী, কিন্তু মানুষের মতাে সুন্দর মন আর কারাে নেই বলে কেউ মানুষের মতাে নয়।

ভাবসম্প্রসারণঃ মানুষকে বলা হয় দ্বিজ অর্থাৎ দুবার জন্মগ্রহণকারী। এ দ্বিতীয় জন্ম বলতে মানবিক গুণাবলি অর্জন করে প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠাকে বােঝায়। একটি শিশু যখন জন্ম নেয়, তখন সে অন্যান্য প্রাণীর মতােই অসহায় থাকে। অন্যান্য প্রাণীর সাথে তার তখন খুব একটা পার্থক্য থাকে না। পরবর্তীকালে শিক্ষাদীক্ষার মাধ্যমে মানুষ অর্জন করে মানবিক গুণাবলি। তখন তার আত্মশক্তির বিকাশ ঘটে। সে প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠে এবং নিজেকে নতুন করে উপলব্ধি করতে শেখে। অপরদিকে, মনুষ্যত্ব বিবর্জিত মানুষ বাহ্যিকভাবে মানুষের মতাে হলেও অন্যান্য প্রাণী ও তার মধ্যে কোনাে পার্থক্য থাকে না। আমরা জানি, সকল প্রাণীরই জীবনধারণের বৃত্তি আছে। কিন্তু মানুষের এ বৃত্তির পাশাপাশি আছে মনুষ্যত্ব, বিবেক ও মানবিক গুণাবলি ! এসব গুণই মানুষকে অন্যান্য প্রাণী থেকে পৃথক করেছে। মানুষের মন আছে বলেই সে হৃদয়বৃত্তির বিকাশের সুযােগ পেয়েছে। যে ব্যক্তি ভালাে-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় বিবেচনা করতে পারে সেই যথার্থ মানুষ । আর যে কখনাে মন্দ কাজ করতে দ্বিধা বােধ করে না, নিজের জন্যে সে যা শ্রেয় মনে করে, অন্যের ক্ষতি হলেও সে তা-ই করে, সে কখনাে প্রকৃত ও পূর্ণাঙ্গ মানুষ বলে গণ্য হতে পারে না। প্রাণ কখনাে মানুষকে মানুষ হিসেবে পরিচিত করে না। একমাত্র বিবেকতাড়িত মনই মানুষকে মানুষ হিসেবে পরিচিত করে । মন আছে বলেই মানুষ পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী । প্রাণ নয়, মনই মানুষকে স্বমহিমায় পরিচিত করে তােলে।

ইচ্ছা থাকিলে উপায় হয় ভাবসম্প্রসারণ

মূলভাব: ইচ্ছা এমন এক শক্তি যার দ্বারা মানুষের মনে একাগ্রতা, ধৈর্য, আগ্রহ, নিষ্ঠা ও অধ্যবসায়ের মতাে গুণাবলির সৃষ্টি হয়। ইচ্ছা মানুষকে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে ধাবিত করে। ইচ্ছাশক্তি প্রবল হলে যেকোনাে কাজে সফলতা লাভ করা সম্ভব। ইচ্ছা থাকলে এর দ্বারা আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে অসাধ্যকে সাধন করা সম্ভব।

ভাবসম্প্রসারণঃ পৃথিবীতে মানুষকে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে হয়। জীবনে চলার পথে পদে পদে রয়েছে নানা বাধাবিঘ্ন। এসব বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে মানুষকে এগিয়ে যেতে হয়। মানুষ তার অন্তরের ইচ্ছাশক্তি দ্বারা সকল বাধাকে অতিক্রম করার চেষ্টা করে। যে মানুষের ইচ্ছাশক্তি প্রচণ্ড শক্তিশালী, সকল বাধা তার কাছে নতিস্বীকার করে। মানবজীবনে বাধা আসবেই, সেজন্যে প্রয়ােজন। আত্মশক্তিতে বলীয়ান হওয়া। মানব চরিত্রে একাগ্রতা, ধৈর্য, অধ্যবসায় ও আগ্রহ ইচ্ছাশক্তির দ্বারাই পরিপূর্ণতা লাভ করে। মানব সভ্যতার যে দুত অগ্রগতি ও উন্নয়ন সাধিত হয়েছে- এর মূলে কাজ করেছে মানুষের ইচ্ছাশক্তি। ইচ্ছার বলেই মানুষ আকাশ-পাতাল এমনকি সমগ্র পৃথিবীকে জয় করেছে। ইচ্ছা না থাকলে মানবজীবন এত সুন্দর ও সার্থক হতাে না। ইচ্ছাহীন। জীবন অর্থহীন। ইচ্ছাশক্তি প্রবল হলে জীবনে সাফল্যও তত দ্রুত হয় । ইচ্ছাশক্তিই মানুষকে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌছে দেয়। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে জনগণের প্রবল ও দৃঢ় ইচ্ছাশক্তির কারণে। দেশের আপামর জনগণ দৃঢ় প্রতিজ্ঞতাবদ্ধ হয়েছিল শত্রুকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দিতে। সেই জন্যে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল এবং জীবন বিসর্জন দিতে দ্বিধা করেনি। আত্মশক্তিতে বলীয়ান ইচ্ছাশক্তির কাছে সেই দিন শত্রুরা মাথা নত করেছিল। প্রবল ইচ্ছাশক্তির কারণে পরাধীন জাতি সকল

বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে দেশকে স্বাধীন করেছে । ইচ্ছা থাকলে যেকোনাে অসাধ্য কাজ সহজে করা সম্ভব। পৃথিবীতে আজ যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের জয়জয়কার তার পেছনের চালিকাশক্তি প্রবল ইচ্ছা।

ইচ্ছাশক্তিই হচ্ছে মানুষের সকল কাজের ও সাফল্যের মূল শক্তি। মানুষের প্রবল ইচ্ছাশক্তির সাহায্যেই পৃথিবী উন্নতির দিকে এগিয়ে চলেছে। তাই ইচ্ছাশক্তি যত প্রবল হবে সফলতা অর্জন তত নিশ্চিত হবে।

অর্থই অনর্থের মূল ভাবসম্প্রসারণ

মূলভাব: এ পৃথিবীতে মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সর্বক্ষেত্রে অর্থের প্রয়ােজন। এমনই গুরুত্বপূর্ণ যে, অর্থ সঠিকভাবে সদ্ব্যবহার না করলে তা অনেক সময় অনর্থের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

ভাবসম্প্রসারণঃ অর্থ মানবজীবনের জন্যে খুবই প্রয়ােজনীয়। কারণ মানবজীবনে প্রতি ক্ষেত্রের কার্যকারিতা অর্থের ওপর নির্ভরশীল । অর্থই আজীবন মানুষের সকল চাওয়া-পাওয়ার প্রয়ােজন মেটায়। অর্থ না থাকলে জীবনে দুঃখকষ্টের শেষ থাকে না। অর্থ না থাকলে অনেক সময় জীবনকে মূল্যহীন বা অর্থহীন বলে মনে হয়। এজন্যেই মানুষ অর্থের পেছনে ছুটে চলেছে নিরন্তর। কী করে অঢেল অর্থ উপার্জন করা যায় সেই চেষ্টার শেষ নেই। কিন্তু অনেক কষ্ট ও সাধনার এ অর্থই অনেক সময় অনর্থের মূল হয়ে দাঁড়ায়। কারণ বেশি অর্থ মানুষকে অন্যায়ের পথে, অপরাধের পথে ঠেলে দেয়। বেশি অর্থ অনেক সময় মানুষকে অমানুষ করে তােলে। অর্থকে কেন্দ্র করে পৃথিবীজুড়ে ঘটে চলেছে নানাবিধ ভয়ংকর, জঘন্য, অমানবিক ও অকল্যাণকর ঘটনা। অর্থের মােহ বড়ই ভয়ানক। অর্থের কারণে পিতা-পুত্র, ভাই-ভাই, রাজায়-রাজায়, দেশে-দেশে ঘটে চলেছে অনেক অপ্রীতিকর ঘটনা। মুক্তিপণ দাবি করে অর্থ আদায় করে, না দিলে প্রাণটা কেড়ে নেওয়া হয়। আর যাদের অর্থ আছে তারা অর্থের বিনিময়ে প্রিয়জনকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালায়। অর্থের লোভ এমনই ভয়ানক যে মানুষ বিবেক, মনুষ্যত্ব, নীতি বিসর্জন দিতে দ্বিধা করে না। আর সমাজের ভয়ানক ব্যাধি যৌতুক, যার বলি হচ্ছে অসংখ্য কন্যাসন্তান।

একথা অস্বীকার করা যায় না যে, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অন্যায়-অনাচার ও দুর্নীতি ইত্যাদির পেছনে অনেক সময় অর্থই প্রধান ভূমিকা পালন করে। তবে অর্থ সকল সময়ই অনর্থের কারণ হয় না। এর ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন থাকলে অর্থ অনেক সময় মর্যাদা বৃদ্ধি করে। ব্যবহারকারী, ব্যবহার ও কার্যকারিতার ওপরই এর ভালাে-মন্দ ভূমিকা নির্ভর করে।

জন্ম হোক যথা তথা কর্ম হোক ভালো ভাবসম্প্রসারণ

মূলভাব: মানুষ পৃথিবীতে স্মরণীয় ও বরণীয় হয় তার কর্মগুণে। সেই সাথে জীবনে গৌরব ও মর্যাদার আসন লাভের পেছনেও থাকে কর্মের ভূমিকা। কর্মের দ্বারা মানুষ প্রতিষ্ঠা লাভ করে । জন্মের বা বংশের তথ্য সেখানে গৌণ।

ভাবসম্প্রসারণঃ কেউ কেউ ভাবেন, মানুষের প্রতিষ্ঠা ও গৌরব লাভের পেছনে বংশপরিচয় গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতপক্ষে তা সঠিক নয়। কারণ মানুষ কোন বংশে জন্মগ্রহণ করেছে তা বিবেচনা না করে জীবনে সে কী অবদান রেখে গেছে সেটাই মানুষের মহিমাকে তুলে ধরে। সমাজের নীচু স্তরে জন্ম নিয়েও অনেক মানুষ কর্ম ও অবদানের মাধ্যমে বড় বলে পরিগণিত হয়েছে। মানবসমাজের ইতিহাসে এ রকম অজস্র উদাহরণ আছে। উঁচু বংশ বা নীচু বংশ বড় কথা নয়, মহৎ অবদানেই মানুষ বড় মাপের মানুষ হয়। কাজী নজরুল ইসলাম, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুসহ আরও অনেকে তাদের কর্মের অবদানের জন্যে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন। এঁরা কেউ জন্মপরিচয় বা বংশগৌরবের কারণে বড় বলে পরিগণিত নন। পদ্মফুলের জন্মস্থান বড় নয়, এর সৌন্দর্য বড়। তেমনি মানুষের কর্মের সাফল্যই বড়, বংশ ও জন্মপরিচয় নয়। কর্মই জীবন। জীবনে কাজ না থাকলে জীবনই ব্যর্থ হয়। মানুষই বিভিন্ন কর্ম দ্বারা দেশ, সমাজ ও জাতির উন্নতি সাধন করে। বংশ বা জন্মপরিচয় দিয়ে দেশের উন্নতি করা যায় না।

মানুষের জীবনের ব্রত হচ্ছে কর্ম কর্মের মধ্যে লুকিয়ে থাকে মানবজীবনের সাফল্য ও ব্যর্থতা। মানুষ কর্মের মাধ্যমে চেষ্টা চালায় জীবনে উন্নতি সাধনে, সাথে সাথে দেশ, জাতি ও সমাজের মঙ্গল সাধনে । মানুষের এ মহৎ কর্মগুণই তাকে অমরত্ব দান করে। জন্মপরিচয় বা বংশগৌরব কখনাে মহৎ গুণের মাপকাঠি নয় ।

একই ভাবসম্প্রসারণের ভিন্ন প্রতিলিপন

মূলভাব : আভিজাত্যে বা বংশ পরিচয়ে মানুষের মর্যাদা বাড়ে না, মহৎ গুণাবলির জন্যই মানুষ প্রকৃত মর্যাদার অধিকারী হয়।

সম্প্রসারিত ভাব : জন্মের ক্ষেত্রে মানুষের নিজের কোনাে ভূমিকা থাকে না। আশরাফ বা আতরাফ, ধনী বা দরিদ্র পরিবারে জন্ম হওয়াটা মানুষের নিজের ইচ্ছা বা কর্মের ওপর নির্ভর নয়। কিন্তু কর্মজীবনে তার ভূমিকা ও অবদানের দায়।তার নিজের ওপর বর্তায়। তাই পৃথিবীতে মানুষের প্রকৃত বিচারে বংশ পরিচয় তেমন গুরুত্ব বহন করে না। বরং কর্মঅবদানের মাধ্যমেই মানুষ পায় মর্যাদার আসন, হয় স্মরণীয় ও বরণীয়। আশরাফ বা অভিজাত বলে অনেকে বংশ গৌরব বড়করে দেখে, কিন্তু তার কাজকর্মে যদি কোনাে গুণ প্রকাশ না পায়, তবে সে বংশ গৌরবের কোনাে অর্থ নেই। জন্ম কোথায় হলাে তা দেখার বিষয় নয়। সবংশে জন্মগ্রহণ করেও যদি কেউ অপকর্মে লিপ্ত থাকে তবে কেউ তাকে শ্রদ্ধা করবে না। অপরপক্ষে, একজন লােক নীচ কুলে জন্মগ্রহণ করেও তার কর্তব্যকর্ম ও চারিত্রিক আদর্শের জন্য সকলের অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা অর্জন করতে পারে। দেশের কাছে, দশের কাছে এবং সৃষ্টিকর্তার কাছে কোনাে একজন মানুষের কর্মই হলাে তার বড় পরিচয়। সরােবরের শ্যাওলা অপেক্ষা গােবরের পদ্মফুলের মর্যাদা অনেক বেশি। মুসলিম জাহানের সর্বপ্রথম মুয়াজ্জিন হযরত বেলাল(রা) একজন ক্রীতদাসের সন্তান হয়েও নিজ কর্মের মাধ্যমে সকলের অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা অর্জন করতে পেরেছিলেন। শেষ বিচারেরদিন আল্লাহ্ কারাে বংশ দেখবেন না, দেখবেন তার কর্ম।

মন্তব্য : বংশের জন্য নয়, কর্মের জন্যই মানুষ প্রকৃত মর্যাদার অধিকারী হয়।

ভাবসম্প্রসারণ: পরের অনিষ্ট চিন্তা করে যেই জন, নিজের অনিষ্ট বীজ করে সে বপন |

মূলভাব : আপনার উপকার হবে ভেবে যেজন অপরের অপকারে আত্মনিয়ােগ করে, পরিণামে সে নিজেই কষ্ট ভােগ করে।

সম্প্রসারিত ভাব : মানুষ সামাজিক জীব। সমাজে মানুষ পরস্পর পরস্পরের সহযােগী হয়ে বসবাস করে। একে অপরের কল্যাণ সাধন করাই মানুষের মানবিক ও নৈতিক ধর্ম। পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণী থেকে মানুষের পার্থক্য হলাে-মানুষ শুধু নিজের কথা চিন্তা করে পৃথিবীতে বেঁচে থাকে না। মানুষকে তার চারপাশের জগৎ নিয়েও ভাবতে হয়। যে মানুষ সর্বদা অন্যের উপকার করার কথা ভাবে এবং নিজেকে সর্বদা অন্যের হিতার্থে ব্যাপৃত রাখে সে সমাজে সম্মানিত হয়। অন্যদিকে, মানুষ যখন নিজের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয় তখন সে অপরের ক্ষতিসাধনে তৎপর হয়। যে মানুষ সর্বদা অন্যের ক্ষতির চিন্তায় মগ্ন থাকে, সে সর্বদা হীনম্মন্য অবস্থায় থাকে। এতে তার চিত্তে শুদ্ধি আসে না বলে সে তার স্বীয় কর্মক্ষেত্রেও উন্নতি করতে পারে না। কেননা, মানুষের স্বার্থবুদ্ধি প্রাধান্য পেলে তার পরিণতি শুভ হয় না। অপরকে ক্ষতিগ্রস্ত করে নিজে লাভবান হওয়ার চেষ্টা অন্যায় কর্ম বলে বিবেচিত হয়। আর এ অন্যায় যারা করে অর্থাৎ নিজের স্বার্থকে যারা বড় করে দেখে তারা মহৎ ব্যক্তি নয়, তাদের কাছ থেকে মহৎ কিছু প্রত্যাশা করা যায় না। তারা সংকীর্ণমনা, অনুদার। তাদের কাজকর্মে শুধু অন্যের একার ক্ষতি হয় না বরং সমাজ ও জাতির পাশাপাশি তার নিজেরও বিরাট ক্ষতি হয়। পার্থিব কর্মের ফল মানুষ কোনাে না কোনােভাবে পৃথিবীতেই পেয়ে যায়। তাই এহেন ব্যক্তিরা নিজেই বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে থাকে। রবি ঠাকুরের ভাষায়-

“যারে তুমি নিচে ফেল, সে তােমারে বাধিছে যে নিচে,

পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তােমারে পশ্চাতে টানিছে।”

মন্তব্য : “To every action there is an equal and opposite reaction.” অর্থাৎ প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি সমান বা বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছে। অর্থাৎ অন্যের যেটুকু ক্ষতি করা হয় তার সমপরিমাণ ক্ষতি নিজেরও হয়ে যায়। তাই অন্যের ক্ষতি করার চিন্তার পরিবর্তে পরােপকারে আত্মনিয়ােগ করাই উত্তম।

কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে দুঃখ বিনা সুখ লাভ হয় কি মহিতে?

মূলভাব : মানব জীবন কুসুমাস্তীর্ণ নয়। অনেক দুঃখ-কষ্টের মধ্য দিয়ে তাকে সুখের স্বর্গ রচনা করতে হয়।

সম্প্রসারিত ভাব : Life is not a bed of roses.’ অর্থাৎ ‘জীবন পুষ্পশয্যা নয়। অনেক কণ্টকাকীর্ণ পথ অতিক্রম করে আমাদের সুখের স্বর্গ রচনা করতে হয়। জীবনের কোনাে মহৎ কর্মই ত্যাগ-তিতিক্ষা ও দুঃখ-কষ্ট ছাড়া সফল হয় না। সংগ্রামী মানুষের গলেই শােভা পায় বিজয় মাল্য। পথ দীর্ঘ দেখে পথিক যদি তার যাত্রা বন্ধ রাখে অথবা কিছুদূর গিয়ে ফিরে আসে তবে সে কোনােদিন গন্তব্য স্থানে পৌঁছতে পারবে না। সেখানে পৌছতে হলে তাকে পথের ক্লান্তি স্বীকার করতেই হবে। স্বীকার করতে হবে পথের সকল প্রতিকূলতা। জয় করতে হবে পথপ্রান্তের সব প্রতিবন্ধকতা। যেব্যক্তি পদ্ম তুলতে গিয়ে কাঁটার ভয়ে ফিরে আসে, সে ব্যক্তির পক্ষে পদ্ম আহরণ করা কখনও সম্ভব হবে না। জীবনে যারাসিদ্ধিলাভ করেছেন, তাদের প্রত্যেককেই বহু বাধা-বিঘ্ন ও দুঃখ-কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। মহামানব হযরত মুহম্মদ (স.)ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে প্রথম জীবনে প্রতি পদক্ষেপে বাধাগ্রস্ত হয়েছেন। আঘাতে রক্তাক্ত হয়েছে তার শরীর, তবু সত্যপ্রচারে এতটুকু পিছপা হননি তিনি। অমানিশার ঘাের অন্ধকার থেকে মানবতাকে দিয়েছেন মুক্তি, ফুলের সৌরভে মাতিয়েতুলেছেন বিশ্বকে। শত লাঞ্ছনা-গঞ্জনা-বঞ্চনা সয়েও সত্যের পথে থেকেছেন অবিচল। অনুরূপ গাজি সালাউদ্দীন, শেরশাহ,নেপােলিয়ন এবং কামাল পাশার মতাে ব্যক্তিরা তাদের স্ব স্ব অবস্থানে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন। বস্তুত, মানুষের জীবনেদুঃখের ভেতর দিয়েই আসে সত্যিকার সুখ।

মন্তব্য : মহৎ সাফল্য সাধনাসাপেক্ষ। জীবনে সফলতা লাভ করতে হলে জীবন পথের সকল বাধা-বিপত্তি ও দুঃখ-দুর্দশা বরণ করে অগ্রসর হতে হবে।

Download From Google Drive

Download

Download From Yandex

Download

👀 প্রয়োজনীয় মূর্হুতে 🔍খুঁজে পেতে শেয়ার করে রাখুন.! আপনার প্রিয় মানুষটিকে “send as message”এর মাধ্যমে শেয়ার করুন। হয়তো এই গুলো তার অনেক কাজে লাগবে এবং উপকারে আসবে।