বাংলা ব্যাকরণের গুরুত্বপূর্ণ সকল রচনা একসাথে পিডিএফ ডাউনলোড

0
467

বাংলা ব্যাকরণের গুরুত্বপূর্ণ সকল রচনা একসাথে

পিডিএফ ডাউনলোড

অধ্যবসায় রচনা

  • অধ্যবসায় রচনার সংকেত
  • ভূমিকা
  • অধ্যবসায়ের স্বরূপ
  • অধ্যবসায়ের প্রয়োজনীয়তা
  • ছাত্রজীবনে অধ্যবসায়
  • ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে অধ্যবসায়
  • প্রতিভা ও অধ্যবসায়:
  • অধ্যবসায়ের দৃষ্টান্ত
  • অধ্যবসায়ের ফল
  • উপসংহার
  • অধ্যবসায় রচনা লিখন

ভূমিকা:

প্রতিটি মানুষই চায় তার স্বপ্নপূরণের পথে সফল হতে। তবে স্বপ্নপুরণ কারো পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে আবার কারো কাছে তা থেকে যায় অধরা। যারা সফল হন তারা সকলেই অধ্যবসায়ী। সফলতার পেছনে একাগ্রচিত্তে নিরন্তর ছুটে চলেন তারা। সম্মুখে বাধা এলেও পিছপা না হয়ে ধৈর্যসহকারে গন্তব্যে পৌছার বিরামহীন প্রচেষ্টাই অধ্যবসায়।

অধ্যবসায়ের স্বরূপ:

বর্তমান পৃথিবী আধুনিক সভ্যতার ধারক। পৃথিবীর মানুষ একদিনে এ অবস্থায় উপনীত হয়নি। গুহাবাসী মানবজাতি হাজার বছরের সাধনা দিয়ে সাজিয়েছে তার প্রিয় আবাস এ পৃথিবীকে । শত-সহস্র বিরুদ্ধ শক্তিকে পরাজিত করে মানুষ আজ নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ হিসেবে । নিরলস সাধনা আছে বলেই মানুষ ছুটে চলেছে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে। নাসা হাউজে বসে রিমোট কনট্রোলে মহাশূন্যে নভোযান পাঠাচ্ছে মানুষ। নভোযান কর্তৃক প্রেরিত নানা রকম ছবি কৌতুহল মেটাচ্ছে মানুষের । এ সব কিছুর পেছনে আছে বহু বছরের পরিশ্রম। কত কত নভোযান মহাশূন্যেই বিলীন হয়েছে । কত আকাশচারীই মহাশূন্যের সীমা খুঁজতে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছেন। কিন্তু মানুষ পরাজয় মানতে রাজি নয় । মানুষ দূর চাদের ধুলােয় এঁকে দিয়েছে তার পদচিহ্ন। মঙ্গলের মাটি খুঁড়ে নভোযান ফিনিকু পৃথিবীবাসীর জন্যে বয়ে এনেছে নতুন বার্তা । নিয়ত বৈরী পরিবেশকে ডিঙিয়ে জয়ী হবার পুনঃপুন এ প্রচেষ্টাই অধ্যবসায়। পৃথিবী আজ এত সাজে সজ্জিত এ অধ্যবসায়েরই ফলে।

অধ্যবসায়ের প্রয়োজনীয়তা:

জীবনে সফল হতে গেলে অধ্যাবসায়ের বিকল্প নেই । যুগে যুগে যে সকল ব্যক্তি সুখ্যাতির উচ্চ শিখরে আরোহন করেছেন তাঁদের সফলতার পেছনে অধ্যবসায় বড় ভূমিকা পালন করেছে । বড় বড় শিল্পী, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, সেনানায়ক, ধর্মপ্রবর্তক সকলেই ছিলেন অধ্যবসায়ী। তাঁরা বারবার ব্যর্থ হয়েও অক্লান্ত পরিশ্রম করে অসীম ধৈর্য সহকারে নিজ নিজ আদর্শের পথে অগ্রসর হয়েছেন।

ছাত্রজীবনে অধ্যবসায়:

ছাত্রজীবনে অধ্যবসায়ের বিকল্প নেই। মানুষের জীবন নির্মাণের প্রস্তুতিপর্ব ছাত্রজীবন। তাই যে ছাত্র। যত বেশি অধ্যবসায়ী সে তত সুন্দর জীবনের অধিকারী হয়। যার ছাত্রজীবন আলস্যে পরিপূর্ণ তার পক্ষে কোনোকালেই নন্দিত জীবনের তৃপ্তিভোগ করা সম্ভব নয়। ছাত্রজীবনের প্রস্তুতিই জীবনের পরিপূর্ণতাকে নির্ধারণ করে। তাই গৌরবময় জীবনের অধিকারী হতে হলে ছাত্রজীবনে অধ্যবসায়ী হতে হবে ।

ব্যক্তি জাতীয় জীবনে অধ্যবসায়:

ব্যক্তিজীবনে মানুষ সকলেই স্বতন্ত্র। বুদ্ধিমত্তা ও শক্তির দিক থেকে সকলেই অসমান। কিন্তু সকলেই উচ্চ জীবনের মহিমা কামনা করে। সে ক্ষেত্রে যদি অধ্যবসায়ের যথার্থ প্রয়ােগ ঘটানাে যায় তবে শক্তির স্বল্পতা সাফল্যের পথে অন্তরায় হয়ে ওঠে না। তাই আত্ম-উন্নয়নের জন্যে চাই অধ্যবসায়। পক্ষান্তরে, জাতীয় জীবনেও গৌরব প্রতিষ্ঠা করতে হলে জাতিকে অধ্যবসায়ী হতে হবে। ব্যক্তির অধ্যবসায় জাতির জন্যে বৃহত্তর কল্যাণ বয়ে আনে। নিতান্ত ক্ষুদ্র ব্যক্তি থেকে আবিষ্কারক, বীরপুরুষ, সমাজ সংস্কারক, রাষ্ট্রনায়ক, শিল্পী, সাহিত্যিক হয়ে বিস্ময়কর যে সাফল্য ব্যক্তি লাভ করে তা অন্য অর্থে জাতিরই সাফল্য। তাই গর্বিত জাতি হিসেবে নিজ রাষ্ট্র বা জাতিকে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড় করাতেও অধ্যবসায় জরুরি।

প্রতিভা অধ্যবসায়:

অনেকে প্রতিভার স্তুতি গাইতে গিয়ে প্রতিভাকে অধ্যবসায়ের ওপর স্থান দেন। বস্তুত সত্য হচ্ছে-প্রতিভা নয়, বরং অধ্যবসায়ই সাফল্যের চাবিকাঠি। যদি এমন কেউ থাকে যে কি না অধ্যবসায়হীন অথচ নিজকে প্রতিভাবান দাবি করে আলস্যে গৃহকোণে পড়ে থাকে তবে তাকে জ্ঞানী বলাই হবে অজ্ঞানীর কাজ। জগতের সকল কীর্তিমানই স্বীকার করেছেন তাদের কৃতকার্যের পেছনে কেবল প্রতিভা ছিল না, ছিল কঠোর অধ্যবসায়ও।

অধ্যবসায়ের দৃষ্টান্ত:

মহা মনীষীদের জীবনচরিত আলােচনা করলে অধ্যবসায়ের দৃষ্টান্ত মেলে। নেপােলিয়ন অধ্যবসায়ী না হলে বলতে পারতেন না, অসম্ভব শব্দটি কেবল বােকাদের অভিধানেই পাওয়া যায়। বিজ্ঞানী নিউটন, আইনস্টাইন, মনীষী কার্লাইল, স্কটল্যান্ডের রাজা রবার্ট ব্রুসসহ জগতের বিভিন্ন মনীষীর জীবনে অধ্যবসায়ের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বর্তমান। কঠোর অধ্যবসায়ের একটি নতুন ইতিহাস রচনা করেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তার উদ্ভাবিত ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি বা গ্রামীণ ব্যাংক পদ্ধতি প্রথমদিকে সমাজের একশ্রেণির মানুষের সমালােচনার মুখে পড়ে। উদ্যম না হারিয়ে প্রবল ধৈর্য সহকারে হাল ধরে রাখেন তিনি। আজ তাঁর গ্রামীণ ব্যাংক নােবেল পুরস্কার অর্জনের মধ্য দিয়ে বিশ্ব স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছে। বিশ্বের বহু দেশ আজ গ্রামীণ ব্যাংকের মডেলকে অনুসরণ করছে— এর পেছনে রয়েছে নিরলস অধ্যবসায়।

অধ্যবসায়ের ফল:

জগতের সকল সুকীর্তি অধ্যবসায়ের ফল । সুদীর্ঘ অধ্যবসায়ের ফলেই মানুষ আজ উদ্ভাবন করতে পেরেছে রােগ নিরাময়ের এতসব ওষুধ। মানুষের আকাশ ভ্রমণ, মহাকাশে বিচরণ, অত্যাধুনিক মুঠোফোন, কম্পিউটারের বিস্ময়কর ব্যবহারে দৈনন্দিন জীবনের নানা কর্মকাণ্ডকে সহজ করে তুলতে পারা– এ সবই অধ্যবসায়ের ফল।

উপসংহার:

বর্তমান যুগ তীব্র প্রতিযােগিতার যুগ। এ যুগে অধ্যবসায়হীন কোনাে মানুষ নিজকে সফলভাবে তুলে ধরতে পারবে না। ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে তাকে অবদান রাখতে হলে অধ্যবসায়কে মূলমন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। কেননা মানবজীবনে অধ্যবসায়ের গুরুত্ব অপরিসীম।

চরিত্র রচনা

  • চরিত্র রচনার সংকেত
  • ভূমিকা
  • চরিত্র কী
  • চরিত্রের বৈশিষ্ট্য
  • চরিত্র গঠনের গুরুত্ব
  • চরিত্র গঠনের উপায়
  • চরিত্র গঠনে পরিবারের ভূমিকা
  • চরিত্র গঠনে সমাজের ভূমিকা
  • শিক্ষার মাধ্যমে চরিত্র গঠন
  • চরিত্রহীনতার কুফল
  • মহৎ চরিত্রের দৃষ্টান্ত
  • উপসংহার

ভূমিকা:

মানুষের আচার-আচরণ ও আদর্শের শ্রেয় ও উৎকর্ষবাচক গুণকেই চরিত্র বলা হয়। এটি মানব-ব্যক্তিত্বের এমন একটি শক্তি যা সততা, ন্যায়-নিষ্ঠা, নীতিপরায়ণতা ও নৈতিক মূল্যবােধের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত। সচ্চরিত্রবান সত্যকথা ও সত্যচিন্তায় বিশ্বাসী, সকল অন্যায়-নিষ্ঠুরতার ঊর্ধ্বে তার অবস্থান। অন্যদিকে, দুশ্চরিত্রবানের অস্ত্রই হলাে মিথ্যাচার, মন্দ কাজ, নিষ্ঠুরতা ইত্যাদি। মানবীয় গুণাবলির মধ্যে চরিত্র অন্যতম। এর মধ্যেই নিহিত থাকে মানুষের প্রকৃত পরিচয়।

চরিত্র কী:

ব্যক্তি বিশেষের গুণাবলিই চরিত্র। এটি ইংরেজি ‘Character’ শব্দের প্রতিশব্দ । বাংলায় চর’ (চলা) ধাতু থেকে শব্দটি গঠিত হয়েছে। অর্থাৎ চরিত্র শব্দের সাথে গতির সম্পর্ক নির্দেশতি হয়েছে। মানুষের জীবনধারার গতির সাথেই চরিত্র- বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে। চরিত্র’ শব্দটি ইতিবাচক অর্থেই ব্যবহৃত হয়। প্রাত্যহিক জীবনে মানুষের চিন্তায়, কর্মে, আচার-আচরণে নৈতিকতা তথা উৎকর্ষবাচক গুণের প্রকাশকেই চরিত্র বলে অভিহিত করা হয়। অন্যদিকে, জীবনাচারে যদি আত্মমগ্নতা, স্বার্থপরতা, নীতিহীনতা প্রকাশ পায় তবে তাকে চরিত্রহীন বলা হয়। চরিত্র মানবজীবনের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে ।

চরিত্রের বৈশিষ্ট্য:

চরিত্রের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করা হয় ব্যক্তিত্বের ইতিবাচক গুণ দিয়ে। নিম্নে উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করা হলাে:

১. সত্য কথা বলা;

২. সত্য চিন্তা করা;

৩. সহৃদয়তা, সংবেদনশীলতা, ন্যায়পরায়ণতা, ক্ষমাশীলতা, কর্তব্যপরায়ণতা, মানবিকতা ইত্যাদি;

৪. হিংসা-বিদ্বেষ ও পরশ্রীকাতরতা বর্জন;

৫. অন্তরশক্তির দৃঢ়তা;

৬. অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে আপসহীনতা;

৭. গুরুজনে ভক্তি;

৮, আত্মসংযম, নিরহংকার, মানবপ্রেম;

৯. সামাজিক রীতি-নীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা;

১০. অধ্যবসায়, বিনয়, ধৈর্য, সৌজন্য, সৌভ্রাতৃত্ব;

১১. দেশপ্রেম, অসাম্প্রদায়িকতা, জাতীয়তাবােধ

এসব বৈশিষ্ট্যের আলােকে ব্যক্তিত্বের বিকাশ সাধন হয় বলে চরিত্রবান ব্যক্তি দেশ ও জাতির সম্পদ। এজন্যই মহানবি হজরত মুহম্মদ (স.) বলেছেন,

তোমাদের মধ্যে সচ্চরিত্রবান ব্যক্তিই আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয়।

চরিত্র গঠনের গুরুত্ব:

গঠনগত দিক থেকে চরিত্রের দুটি দিক- ১. সচ্চরিত্র, ২. দুশ্চরিত্র। ইতিবাচক গুণের সমন্বয়ে গঠিত হয় সচ্চরিত্র আর নেতিবাচক গুণ তথা পশুত্ব নিয়ে গঠিত হয় দুশ্চরিত্র। মানজীবনে চরিত্র গঠনের গুরুত্ব স্বল্প কথায় অপ্রকাশ্য। বিদ্যার চেয়ে চরিত্রের মূল্য অধিকতর। কেননা দুশ্চরিত্রবান বিদ্বান সমাজের বা দেশের কল্যাণের পরিবর্তে অকল্যাণই করে বেশি। অন্যদিকে, শুধু চরিত্রবলেই মানুষ হতে পারে বিশ্ববরেণ্য। অহিংস মনোভাব নিয়েই দেশ, জাতির কল্যাণ সম্ভব হয়। আর তা একমাত্র সচ্চরিত্রবানের পক্ষেই সম্ভব। তাই চরিত্র গঠনের গুরুত্ব অপরিসীম। এক্ষেত্রে একটা প্রচলিত সুভাষণ স্মরণযােগ্য:

‘অমরত্বের সুধা পান না করেও মানুষ অমর হতে পারে কেবল চরিত্রের গুণে।

চরিত্র গঠনের উপায়:

চরিত্র গঠনে ব্যক্তির নিজস্ব সাধনা যেমন প্রয়ােজন তেমনি প্রয়ােজন পারিপার্শ্বিক সহযােগিতা। মানুষের সম্পূর্ণ জীবনকালই চরিত্র গঠনের সময়। তবে শিশুবয়সই এর উৎকৃষ্ট সময়। তাই চরিত্র গঠনের প্রাথমিক পর্ব শুরু হয় নিজ পরিবারেই। যেসব উপায়ে চরিত্র গঠন হতে পারে তার মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলাে— ১. পরিবারের সহায়তায়, ২. সমাজের সহায়তায়, ৩. পরিবেশের সহায়তায়, ৪. ব্যক্তির নিজস্ব সাধনায়, ৫. শিক্ষার মাধ্যমে ।

চরিত্র গঠনে পরিবারের ভূমিকা:

শিশুর চরিত্র গঠনে পরিবারই উপযুক্ত স্থান, শিশুরা অনুক্ৰণপ্রিয়। তাই বাবা-মা, ভাই-বােন, সঙ্গী-সাথি, আত্মীয়স্বজনের প্রভাব তাদের ওপর বেশি পড়ে। শিশুর সুসংহত ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্যে পরিবারের সবাইকে সচ্চরিত্রের গুণগুলো চর্চা করতে হবে।বাস্তবসম্মতভাবে তাদেরকে নৈতিক উপদেশ দিতে হবে। ব্রাট্রান্ড রাসেল শিশুর চরিত্র গঠনে কতগুলো বিষয়ের উল্লেখ করেছেনঃ-

১.সত্য কথা ও সত্য চিন্তায় অভ্যস্ত করতে

২.স্নেহ ও সমবেদনারশিক্ষা দিতে হবে।

৩.নৈতিক গুণাবলির অধিকারি হতে হবে।

৪.স্বার্থপরতা কীভাবে ক্ষতিকর তা বুঝিয়ে দিতে হবে

৫.অন্যায়-অত্যাচারের নেতিবাচক দিক সম্পর্কে শিশুকে জানতে দিতে হবে। খুব কাছ থেকে শিশুকে নৈতিক চরিত্রের শিক্ষাদান পরিবারের পক্ষেই সম্ভব। আবার শিশুর চরিত্র বিকাশে পরিবারকে বিশেষ সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে সঙ্গ নির্বাচনে। কেননা সৎসঙ্গই শিশুর প্রতিভা বিকাশে সহায়ক। অন্যথায় অকালেই অনেক সম্ভাবনাময় প্রতিভা অন্ধকারে হারিয়ে যাবে । সকল নিষ্ঠুরতা থেকে শিশুকে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে। পাশাপাশি সৃষ্টিশীল কাজে শিশুকে উৎসাহিত করতে হবে। এভাবেই চরিত্র বিকাশে পরিবার পালন করে প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তবে শিশুর চরিত্র গঠনে শিক্ষক-শিক্ষিকাও পালন করেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

চরিত্র গঠনে সমাজের ভূমিকা:

চরিত্র গঠনে সমাজের ভূমিকাও অনস্বীকার্য। বিশেষত শৈশবে চরিত্র বিকাশে সমাজ-পরিমণ্ডল পালন করে অন্যতম সহায়ক ভূমিকা । পাড়া-প্রতিবেশী, সমবয়স্ক সঙ্গী-সাথি সবার সাথে মানবজীবন অতিবাহিত হয়। তাই এদের সবার প্রভাবেই গড়ে ওঠে ব্যক্তি চরিত্র । ফলে সামাজিক জীবনাচার যেন সৎ ও সুন্দর গুণাবলির সমন্বয়ে গঠিত হয় তার দিকে দৃষ্টি রাখতে হবে সবাইকে। চরিত্র গঠনে পরিবেশের ভূমিকা: সুস্থ পরিবেশ মানুষের সুস্থ জীবনের ধারক। সুস্থ জীবনযাপনের মধ্যেই বিকশিত হয়। সুস্থ মন। সুস্থ মনই পারে সুন্দর ও কল্যাণের পূজা করতে। অর্থাৎ সুস্থ পরিবেশেই ঘটে সুস্থ মানসিকতার বিকাশ। সুস্থ মানসিকতা মানেই আনন্দপূর্ণ জীবন। তাই সচ্চরিত্র গঠনে পরিবেশের ভূমিকা অনবদ্য। তাই পরিবেশ যাতে দূষিত না হয়, বিষন্ন না হয় সেদিকে সবাইকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে চরিত্র গঠনে ব্যক্তিসাধনা: চরিত্র গঠনে ব্যক্তিমনের দৃঢ়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রয়োজনীয় চারিত্রিক গুণাবলি অর্জন করতে হল ব্যক্তির নিজের প্রতি সুদৃঢ় সম্মানবােধ থাকতে হবে। তবেই যাবতীয় পাপ-পঙ্কিলতা ও অন্যায় নিষ্ঠুরতা থেকে সে নিজেকে সরিয়ে রাখার শক্তি অর্জন করবে। নিজেকে যে সম্মান করতে পারে সে অপরের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল হতে পারে। ফলে মানবিক মূল্যবােধই তার কাছে সর্বাগ্রে স্থান পায়। যা তার চরিত্রকে দেয় সুদৃঢ় ভিত্তি। তাই চরিত্রকে নির্মল, পরিচ্ছন্ন করার লক্ষ্যে মানুষকে আমৃত্যু কঠোর সাধনা করতে হয় ।

শিক্ষার মাধ্যমে চরিত্র গঠন:

শিক্ষা শুধু জ্ঞানার্জনেই সহায়তা করে না, উন্নত চরিত্র গঠনেও সাহায্য করে। উন্নত চরিত্র গঠনের জন্যে প্রাণশক্তি, সাহস, সংবেদনশীলতা ও বুদ্ধির সমন্বয় প্রয়ােজন। শিক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তির মধ্যে এ বৈশিষ্ট্যগুলোর সঞ্চারণ করা হয়। পাঠ-প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীর মনে সাবলীলভাবে বেঁচে থাকার প্রেরণা জোগানো হয় এবং জীবনীশক্তির সঞ্চার করা হয়। জীবনের প্রতি জাগ্রত আগ্রহ ব্যক্তির সুস্থ মানসিকতা গঠনে সহায়তা করে। আবার শিক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তি নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। ফলে নিজের বিচার বিবেচনা দ্বারা আচরণবিধি তৈরি করে। আত্মবুদ্ধিতে পরিচালিত হওয়ার এ সাহস ব্যক্তিকে সচ্চরিত্রবান মানুষ হিসেবে গড়ে তােলে। সংবেদনশীলতা ব্যক্তিচরিত্রর উল্লেখযােগ্য দিক । ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সঠিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিই

সংবেদনশীলতার যথার্থতা । যা ব্যক্তির নৈতিক মূল্যবােধের জন্যে খুবই প্রয়ােজন। শিক্ষা মানুষের

মননবিকাশের মাধ্যমে সংবেদনশীলতার যথার্থতা প্রদান করে। ফলে অমঙ্গলের প্রভাব থেকে ব্যক্তি নিজেকে মুক্ত রেখে।চারিত্রিক সমৃদ্ধি ঘটায়। সর্বোপরি শিক্ষার মাধ্যমেই ব্যক্তির বৌদ্ধিক বিকাশ সাধিত হয়। ব্যক্তি লাভ করে উদার দৃষ্টিভঙ্গি। চিন্তার ক্ষেত্রে এ দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্তিকে ভালাে-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। এভাবেই শিক্ষা ব্যক্তির উন্নত চরিত্র গঠনে সহায়তা করে।

চরিত্রহীনতার কুফল:

মানব জীবনের সর্বোৎকৃষ্ট সম্পদ চরিত্র। চরিত্রহীন ব্যক্তির মনে আশ্রয় নেয় পাশব চিন্তা। আত্মচিন্তায় বিভাের থাকে বলে চরিত্রহীন ব্যক্তি লোভ-লালসায় মত্ত হয়ে পড়ে যেকোনাে পাপ কাজ করতে তার অন্তর কাপে না। তারা সমাজ ও দেশের কলঙ্ক। সবার ঘৃণাই তাদের পাথেয়। যতই বিত্তশালী হােক না কেন চরিত্রহীন মানুষ কখনােই কারও শ্রদ্ধা। ভালোবাসা পায় না। তাদের জীবন পশুর জীবনের চেয়েও নিকৃষ্ট।

মহৎ চরিত্রের দৃষ্টান্ত:

চরিত্রশক্তিতে বলীয়ান ব্যক্তিগণ অমরত্ব নিয়ে মানব মনে বেঁচে থাকে চিরকাল। অন্যায়, অসত্য ও পাপের বিরুদ্ধে এসব মহৎ ব্যক্তিদের দৃঢ় অবস্থান অক্ষয় ঔজ্জ্বল্য নিয়ে আলােকিত করে সবাইকে। তারা ধনসম্পদে সমৃদ্ধ হলেও গৌরবৌশ্বর্যে মহীয়ান। এমনই চরিত্রের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হজরত মুহাম্মদ (স.), যিশু খ্রিস্ট, গৌতমবুদ্ধ, বিদ্যাসাগর, রাজা রামমােহন রায়, মহাত্মা গান্ধী, মওলানা ভাসানী, হাজী মুহম্মদ মুহসীন প্রমুখ। এরা সবাই মানবব্রতী, দেশব্রতী, উন্নত ও মহৎ চরিত্রের অধিকারী।

উপসংহার:

দিকে দিকে আজ অমঙ্গলের প্রভাব পরিলক্ষিত। মানুষের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা যেন বিলুপ্ত। বিশ্বব্যাপী আজ বেড়েছে পরিভােগ প্রবণতা এবং কমেছে মূল্যবােধ। এমতাবস্থায় চরিত্রের নবজাগরণ একান্ত প্রয়ােজন। কেননা চরিত্রবান নাগরিকই অনৈতিকতার অন্ধকার থেকে জাতীয় জীবনকে রক্ষা করতে পারবে । চরিত্রের মহিমায় মানুষকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে মূল্যবােধ | কবির কণ্ঠে মহৎ চরিত্র গঠনের বাণী শােনা যায়;

কর্তব্যনিষ্ঠা রচনা

কর্তব্যনিষ্ঠা রচনার সংকেত

  • ভূমিকা
  • কর্তব্যনিষ্ঠা কী
  • কর্তব্যনিষ্ঠার প্রয়ােজনীয়তা
  • কর্তব্যনিষ্ঠার ফল
  • কর্তব্যনিষ্ঠার প্রকাশ
  • কর্তব্যনিষ্ঠা চর্চার গুরুত্ব
  • উপসংহার

ভূমিকা:

কর্তব্যকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করে যথাযথভাবে পালন করাই কর্তব্যনিষ্ঠা। মানুষ জীবনে সফল হতে চাইলে এ বিশেষ গুণটি তার আয়ত্ত করা চাই। জীবনের ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে নানাভাবে কর্তব্য এসে মানবজীবনে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে যায়। কর্তব্য সম্পাদন থেকে মানুষ পরিত্রাণ আশা করতে পারে না। কর্তব্যকে এড়িয়ে যাওয়ার মধ্যে সম্মান নিহিত নেই, বরং কর্তব্য পালনের মধ্যেই মানুষের তৃপ্তি পাওয়া উচিত। কর্তব্যনিষ্ঠ মানুষমাত্রই সফল জীবনের অধিকারী। তাই কর্তব্যনিষ্ঠাই অগ্রযাত্রার সােপান।

কর্তব্যনিষ্ঠা কী:

সাধারণত কাজের প্রতি আগ্রহ এবং নিষ্ঠাকে কর্তব্যনিষ্ঠা বােঝায়। নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সুচারুরূপেপালন, বিবেকবােধে উজ্জীবিত হয়ে আপন কর্তব্য সম্পাদন, দায়িত্বকে সম্পূর্ণভাবে আন্তরিকতা দিয়ে গ্রহণ করা কর্তব্যনিষ্ঠার লক্ষণ। নামেমাত্র কাজ করা কাজ হলেও কর্তব্যনিষ্ঠা নয়। কেননা সমাজে এক শ্রেণির মানুষ আছে যারা কর্তব্যের মধ্যেও ভেজাল ঢুকিয়ে দেন। দায় সারা গােছের কর্তব্য পালনে কোনাে কৃতিত্ব নেই বরং এহেন কর্মও সুকর্ম নয়। কাজে শতভাগ মনােযােগ এবং প্রজ্ঞার পরিচয় না থাকলে তা কর্তব্যনিষ্ঠা নয়। যুগে যুগে বিশ্বজুড়ে সমাজ ও সভ্যতার যে অগ্রগতি সাধিত হয়েছে তার মূলেও আছে কর্তব্যনিষ্ঠ মানুষের কঠোর শ্রম। কর্তব্যের ধরন ও প্রকৃতি: স্থান, কাল, অবস্থান ও কর্ম দক্ষতার বৈচিত্র্যই কর্তব্যের প্রকৃতিকে দেয় নানা মাত্রিকতা । এক জন শিক্ষকের কর্তব্য এবং ছাত্রের কর্তব্য এক ধরনের নয়। আবার একজন গৃহকর্তার কর্তব্য এবং পেশাজীবীর কর্তব্যেও আছে বৈচিত্র্য। কর্তব্য কাজে নানা বৈচিত্র্য থাকলেও মানুষ হিসেবে সকলেরই কিছু সাধারণ দায়িত্ব আছে সেগুলােকে মৌলিক দায়িত্বও বলা যেতে পারে। পরিবারের সদস্য হিসেবে একে অন্যের প্রতি করণীয় কর্তব্য পালন করা এবং সামাজিক জীব। হিসেবে সমাজের কল্যাণমূলক কাজে নিজেকে সংযুক্ত করাও কর্তব্যবােধের উদাহরণ।

কর্তব্যনিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা:

ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবনে শুধু কর্তব্যনিষ্ঠার বিষয়টি জড়িত নয়। একজন ব্যক্তি একটি দেশ বা রাষ্ট্রে বাস করে বলে তার ওপর নাগরিক কর্তব্যের বিষয়টিও বর্তায়। নাগরিকের দায়িত্ব পালন প্রকৃতপক্ষে জাতিকে অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। যে দেশের নাগরিক যতবেশি কর্তব্যনিষ্ঠ সে দেশের নাগরিকদের নাগরিকমান এবং দেশ তত উন্নত। বিশ্বে যে কয়টি দেশ অর্থনৈতিকভাবে সর্বোচ্চ সমৃদ্ধিশীল বলে বিবেচিত সেসব দেশের মানুষ কর্তব্যনিষ্ঠ — এ সত্যটি আজ সংশয়হীনভাবে স্বীকৃত। ব্যক্তিজীবনে সাফল্য পেতে হলেও মানুষকে কর্তব্যনিষ্ঠ হতে হবে। পৃথিবীতে যত জ্ঞানী-গুণী সাফল্যের স্বর্ণতােরণে উত্থিত হয়েছেন তাদের সকলের মধ্যে ছিল কর্তব্যনিষ্ঠার মতাে মহৎ গুণ। কর্তব্যনিষ্ঠ না হয়ে দিবাস্বপ্ন দেখলে জীবনে সাফল্য ধরা দেয় না। তাই কর্তব্যনিষ্ঠাকে সর্বাগ্রে মূল্য দিতে হবে, কর্তব্যকে গ্রহণ করতে হবে আন্তরিক আগ্রহে।

কর্তব্যনিষ্ঠার ফল:

কর্তব্যনিষ্ঠার প্রধান ফল হচ্ছে সাফল্য। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের যেখানে সাফল্যের উদাহরণ বর্তমান সেখানে রয়েছে কর্তব্যনিষ্ঠার নিপুণ প্রয়ােগ । মানুষের কর্তব্য নিষ্ঠাই বিকাশ ঘটিয়েছে সভ্যতা ও সংস্কৃতির। চলমান সময়ে প্রযুক্তির সাহচর্যে এসে মানুষ যে সুখ ভােগ করছে এর পেছনে আছে মানুষের কর্তব্যনিষ্ঠা । বিজ্ঞানী, শিল্পী, সাহিত্যিক যারা জগতে অবিস্মরণীয় অবদান রেখে গেছেন তা প্রকৃতপক্ষে তাদের কর্তব্যনিষ্ঠারই ফল। তারা দিনে দিনে সঠিক কর্তব্য সম্পাদনের মধ্য দিয়ে। এগিয়ে গেছেন সাফল্যের দিকে। তাই আগামী সাফল্যকে ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে ধারণ করতে হলে আমাদের হতে হবে কর্তব্যপরায়ণ ।

কর্তব্যনিষ্ঠার প্রকাশ:

প্রত্যেকটি মানুষের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সে কেমন করে পালন করে তার মধ্য দিয়ে প্রকাশ ঘটে কর্তব্যনিষ্ঠার । জীবিকার অনিবার্য প্রয়ােজনে মানুষ চাকরি গ্রহণ করে। কিন্তু চাকরিকালে সকলেই কর্তব্যনিষ্ঠার সমান পরিচয় প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। কেউ কেউ কেবল সময়কে অতিক্রমের চেষ্টায় ব্যস্ত। মাস গেলে মাইনে পাবে আর অবসর জীবনে পাবে অবসর ভাতা এ নিয়ে ভাবনা যার তার পক্ষে কর্তব্যনিষ্ঠ হওয়া কঠিন। কর্তব্যনিষ্ঠ ব্যক্তি অতি সহজেই অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে। ফলে তার কর্মজীবন হয়ে ওঠে আনন্দময়। কাজের মধ্য দিয়েই কর্তব্যনিষ্ঠ ব্যক্তি সকলের কাছে। সদগুণের প্রতিষ্ঠা করে। পক্ষান্তরে, কর্তব্যনিষ্ঠ নয় এমন ব্যক্তি সহকর্মীদের কাছে পরিচিত হন মন্দ মানুষ হিসেবে। তাই প্রতিটি মানুষের উচিত কর্তব্য পালনের মধ্য দিয়ে কর্তব্যনিষ্ঠার পরিচয় প্রতিষ্ঠা করে জাতীয় উন্নতি ত্বরান্বিত করা।

কর্তব্যনিষ্ঠা চর্চার গুরুত্ব:

কর্মদক্ষতা ও অবস্থানগত কারণে কারও কর্তব্য পালনের ক্ষেত্রটি ছোট আবার কারও ক্ষেত্রটি বড় তাই বলে কর্তব্য ছোট নয়। সকল কর্তব্যই কর্তব্য। মানবজীবনে কর্তব্য চর্চার বিষয়টি বিশেষ প্রয়ােজন কেননা কর্তব্যবােধ হঠাৎ করে জন্মায় না, তাকে চর্চা করার মধ্য দিয়ে নিজের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করতে হয়। কথায় বলে কর্তব্যের কাছে ভাই-বন্ধুকেউ নেই। কর্তব্যনিষ্ঠ নয় এমন যে কেউ কর্তব্য পালনে কর্তব্যহীনতার পরিচয় দিতে পারে। বিচারকের আসনে বসে স্বজন-পরিজনকে ক্ষমা করে দেবার চেষ্টা কর্তব্যনিষ্ঠার উদাহরণ নয়। তাই কর্তব্যনিষ্ঠা চর্চা থাকলেই কর্তব্যের কাছে ভাই-বন্ধুনেই’— কথাটি সত্য হতে পারে। স্বাধীন জাতি হিসেবে, আত্মমর্যাদাবােধ সম্পন্ন জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে হলে প্রয়ােজন।কর্তব্যনিষ্ঠাকে সমাজজীবনে চর্চা করা, কর্তব্যনিষ্ঠাকে জাতীয় চরিত্রের বৈশিষ্ট্য হিসেবে গ্রহণ করা। কবির ভাষায়—

“দুঃখ সুখ দিবস রজনী মন্ত্রিত করিয়া তােলে জীবনের মহামন্ত্রধ্বনি শত শত সাম্রাজ্যের ভগ্নশেষ পরে। ওরা কাজ করে।’

উপসংহার:

ব্যক্তির কর্তব্যনিষ্ঠার প্রভাব পড়ে সমাজজীবনে। তাই একটি উন্নত সমাজ বিনির্মাণে সকলের কর্তব্যনিষ্ঠ হওয়া জরুরি। জাতি কর্তব্যনিষ্ঠ হলে জাতীয় অগ্রগতি নিশ্চিত। পক্ষান্তরে, জাতি কর্তব্যনিষ্ঠ না হলে তার ধ্বংসও ঠেকিয়ে রাখা যায়। অতএব কর্তব্যনিষ্ঠার গুরুত্বের কথা স্বীকার করে এর চর্চা এবং সকলের মাঝে বিস্তার ঘটানােই আমাদের করণীয়।

জনসেবা রচনা

  • ভূমিকা
  • জনসেবার স্বরূপ
  • জনসেবার গুরুত্ব
  • ধর্মীয় দৃষ্টিতে জনসেবা
  • জনসেবার উপায়
  • জনসেবা ও সেবা প্রতিষ্ঠান
  • উপসংহার

ভূমিকা:

আত্মচিন্তায় মগ্ন থাকা জীবনের আসল উদ্দেশ্য নয়। পরের কল্যাণে আত্মনিয়ােগের মাধ্যমে নিজের জীবনের বিকাশ সাধনই জীবনের মূলকথা। অর্থাৎ সে জীবনই সার্থক যে জীবন পরের তরে নিবেদিত । জীবন মানে মায়া, জীবন মানে মমতা আর জীবন দিয়েই জীবনকে চিনতে হয়। জীবনকে চিনলেই অর্জিত হয় মনুষ্যত্ব। জনসেবা মনুষ্যত্ব অর্জনের যথার্থ ভিত্তি, স্বার্থের আবিলতা বর্জিত সেবাই হলাে জনসেবা। কবির ভাষায় –

‘আপনা রাখিলে ব্যর্থ জীবন সাধনা।

জনম বিশ্বের তরে পরার্থে কামনা।

জনসেবার স্বরূপ:

‘এ জীবন ক্ষণভঙ্গুর, তারাই যথার্থ জীবিত যারা অপরের জন্য জীবন দান করে’ স্বামী বিবেকানন্দের এ কথায় নিহিত আছে জনসেবার মর্মার্থ । নিজের স্বার্থকে উপেক্ষা করে বৃহত্তর জনগােষ্ঠীর কল্যাণ সাধন করার নামই জনসেবা।

মানবজীবন ক্ষণস্থায়ী। এ স্বল্পসময়ে সে সমাজবদ্ধ হয়। সমাজে সে নিজেকে আত্মকেন্দ্রিক বলয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে বরং সবার সঙ্গে বাঁচে। পরের কল্যাণে জীবনােৎসর্গ করে সে জীবনের সার্থকতা খোঁজে। কিন্তু সমাজের মানুষের কল্যাণ

সাধন করার মধ্যেই জনসেবার প্রকৃত স্বরূপ উদঘাটিত হয় না। জনসেবার ধারণা আরও ব্যাপক ও বিস্তৃত। যে সেবার দ্বারা দেশ ও জাতির সামগ্রিক কল্যাণ সাধিত হয় তাই জনসেবা, আরও ব্যাপক অর্থে বিশ্বের বিপন্ন মানবতার সেবা করাই জনসেবা। বিখ্যাত লেখক Ruskin-এর মতে,

There are three kinds of duties, duties towards god, duties towards parents and duties towads mankind.’

মানবকল্যাণের কর্তব্যই মূলত জনসেবা। সহজ কথায়, আমার বিবেচনা না করে দেশ-জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সর্বস্তরের জনগণের সেবা বা কল্যাণ সাধনই জনসেবা। মানুষ তার মৌলিক গুণাবলি ও কর্মপ্রচেষ্টার মাধ্যমে বিশ্বশান্তি ও কল্যাণ বয়ে আনতে পারে। এতেই জীবনের প্রকৃত সার্থকতা, তাইতাে কবি বলেছেন-

‘স্বার্থমগ্ন যে জন বিমুখ বৃহৎ জগৎ হতে

সে কখনো শেখেনি বাচিতে।

জনসেবার গুরুত্ব:

জীবনকে পরিপূর্ণ সার্থক ও সমৃদ্ধ করতে হলে জনসেবার বিকল্প নেই। প্রার্থে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করার মধ্যেই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারিত। মনুষ্যত্ব মানবচরিত্রের অমূল্য সম্পদ। আর আত্মমগ্ন মানুষ কখনাে মনুষ্যত্ব অর্জন করতে পারে না। কেননা মনুষ্যত্ব অর্জনের কঠিন সাধনা একমাত্র জনগণের কল্যাণ সাধনে নিজেকে নিয়ােজিত করার মাধ্যমেই সম্ভব। সমাজ, দেশ, বৃহত্তর অর্থে বিশ্বের শান্তি ও উন্নতি মানুষের সেবাব্রতের মহৎ চিন্তার মাধ্যমেই সম্ভব। ইতিহাস পর্যালােচনায় আমরা দেখব, যে দেশে জনসেবার মহৎ ব্রতে আত্মসুখ বর্জনের দীক্ষা নিয়েছে যত বেশি লােক, সে দেশের উন্নয়ন তত বেশি ত্বরান্বিত হয়েছে। সমাজ, দেশ তথা বিশ্ব মানবতার প্রতি মানুষের অকৃত্রিম কর্মপ্রচেষ্টা এবং স্বার্থত্যাগই দিতে পারে স্বর্গীয় আনন্দোপলব্ধি। তাই ক্ষণস্থায়ী জীবন শুধু নিজের করে না রেখে সকলের জন্যে বিলিয়ে দেয়া উচিত। সর্বজনীন কল্যাণ সাধনের মাধ্যমেই নিজেকে শ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে গড়া যায় এবং মানব ইতিহাসে অমরত্ব পাওয়া যায়। তাইতাে কবি বলেছেন-

‘যা রাখি আমার তরে মিছে তারে রাখি

আমিও রব না যবে সেও হবে ফাকি,

যা রাখি সবার তরে, সেই শুধু রবে

মাের সাথে ডােবে না সে, রাখে তারে যবে ।

ধর্মীয় দৃষ্টিতে জনসেবা:

সকল জাতির সকল ধর্মেই জনসেবার মহান ব্রতকেই শ্রেষ্ঠত্ব দেওয়া হয়েছে। ধর্মীয় চেতনাই মানুষকে সেবাব্রতে অনুপ্রাণিত করেছে। প্রাচীনকালে ধর্মীয় চেতনার আশ্রয়ে সেবাব্রত ব্যাপক অভিব্যক্তি পেয়েছিল। কোরান, বাইবেল, গীতা, ত্রিপিটক—বিভিন্ন ধর্মশাস্ত্রে ধর্মসাধনার প্রকৃত পথ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে জনসেবাকেই। মহানবি হজরত মুহম্মদ (স.) বলেছেন, সব কাজের মধ্যে সমাজ কল্যাণের কাজই শ্রেষ্ঠ এবং মানুষের মধ্যে তিনিই শ্রেষ্ঠ যিনি মানুষের উপকার করেন। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন- ‘জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।’ মানবকল্যাণ সাধনার ব্রতে গৌতম বুদ্ধ ত্যাগ করেছিলেন রাজসিংহাসন। জগতের ধর্মপ্রবক্তারা মানুষের কল্যাণেই খুঁজেছেন ঈশ্বরের অস্তিত্ব।

জনসেবার উপায়:

মহৎ কর্মসাধনার মাধ্যমে মানুষের কল্যাণ সাধনই জনসেবার প্রাণকথা। নানা উপায়ে এ কল্যাণ সাধন সম্ভব। কবি রজনীকান্ত সেন তার কবিতার মাধ্যমেই জনসেবার মহৎ আদর্শ ও উপায় চিহ্নিত করেছেন।

অন্নহীনে অন্নদান, বস্ত্র বস্ত্রহীনে,

তৃষ্ণাতুরে জলদান, ধর্ম ধর্মহীনে,

মূখজনে বিদ্যাদান, বিপন্নে আশ্রয়,

রােগীরে ঔষধ দান, ভয়ার্তে অভয়,

গৃহহীনে গৃহদান, অন্ধেরে নয়ন,

পীড়াতে আরােগ্যদান, শােকার্তে সান্ত্বনা

স্বার্থশূন্য হয় যদি এ দ্বাদশ দান,

স্বর্গের দেবতা নহে দাতার সমান।

অর্থাৎ নিঃস্বার্থ মহৎ মনােভাব নিয়ে আর্ত মানবতার কল্যাণ সাধনের মাধ্যমে জনসেবার মহান ব্রত পালন করা যায়।

জনসেবা সেবা প্রতিষ্ঠান:

জনসেবার মহান ব্রত পালনের উদ্দেশ্য নিয়ে কালের ধারায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অনেক সেবামূলকপ্রতিষ্ঠান। নানামুখী কার্যক্রমের মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠান মানবজাতির উন্নয়ন ও কল্যাণে নিয়ােজিত। দৈশিক ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম প্রশংসার দাবিদার। এছাড়াও বিভিন্ন সংঘ, সমিতি, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। জনসেবামূলক নানান কর্মসূচি পালন করে থাকে। অসহায় মানুষের মুখে হাসি এবং প্রাণে বাঁচার আগ্রহ সৃষ্টিতে এসব সেবামূলক প্রতিষ্ঠান রাখছে অনন্য ভূমিকা।

উপসংহার:

সেবাধর্ম মানুষের অন্তরের মহত্তম গুণ। যে গুণের মাধ্যমে মানুষ লাভ করে প্রকৃত সুখ এবং জীবনকে করে পরিপূর্ণ সার্থক। নিজের স্বার্থ বলি দিয়ে অন্যের দুঃখ লাঘবের মাধ্যমে মানুষ জীবনের সত্যিকার অর্থ খুঁজে পায়। মানবতার কল্যাণ ব্ৰতেই মানুষ পায় নির্মল আনন্দের সন্ধান। তাই জনসেবার মহৎ আদর্শে উদ্দীপ্ত হতে হবে সবাইকে। কেননা

মিতব্যয়িতা রচনা

মিতব্যয়িতা রচনার সংকেত

  • ভূমিকা
  • সম্পদ সঞ্জয়
  • মিতব্যয়িতা ও সঞ্চয়
  • মিতব্যয়িতার প্রয়ােজনীয়তা
  • মিতব্যয়িতা ও কার্পণ্য
  • অমিতব্যয়িতার পরিণাম
  • মিতব্যয়িতা ও আজকের সমাজ
  • উপসংহার

ভূমিকা:

নিরর্থক অপচয় না করে সম্পদের পরিমিত ব্যয়ের অভ্যাসের নাম মিতব্যয়িতা। মিতব্যয়িতা মানব চরিত্রের একটি বিশেষ গুণ। যে ব্যক্তি প্রচুর উপার্জন করে কিন্তু মিতব্যয়ী নন তাকে অন্যের দ্বারস্থ হতে হয়, ফলে তার জীবন হয়ে ওঠে অসুখী। পক্ষান্তরে, কোনাে ব্যক্তি অনেক বেশি উপার্জন হয় তাে করে না, কিন্তু তার ব্যয়ে পরিমিতিবােধ আছে তাকে অন্যের কাছে হাত পাততে হয় না, ফলে সে সুখী। তাই ব্যক্তিজীবনে মিতব্যয়িতা চর্চা মানুষকে দেয় দুশ্চিন্তাহীন নান্দনিক জীবন।

সম্পদ সঞ্জয়:

বর্তমান জগতে অর্থ বিনা কোনাে বস্তুই লাভ করা যায় না । তাই মানুষ ক্লান্তিহীন ছুটে চলে অর্থের পিছু পিছু। সম্পদ সঞ্চয়ের জন্যে মানুষ উপার্জন করে ন্যায় পথে এবং অন্যায় পথে। কেউ কেউ সমাজে তার উঁচু অবস্থান নিশ্চিত করতে চায় অর্থের মাধ্যমে। মনে রাখতে হবে, সম্পদের পর্যাপ্ততাই মানুষের বিচারের মাপকাঠি নয়, তার সম্পদের ব্যয়ের দিকটিও লক্ষ করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে সম্পদ সঞ্চয় এবং সম্পদের ব্যয়ে সামঞ্জস্যপূর্ণ সমন্বয় চর্চার মধ্যেই মিতব্যয়িতা বর্তমান । তাই সম্পদের শুধু সঞ্চয় নয়, এর সুসংগত ব্যয়ও জরুরি।

মিতব্যয়িতা সঞ্চয়:

সংগ্রামশীল জীবনে শুধু বর্তমানেই মানুষকে টিকে থাকলে চলে না তাকে ভবিষ্যতের ভাবনাও ভাবতে হয়। যে মানুষের ব্যয়ে সংযম নেই তার পক্ষে ভবিষ্যতের জন্যে সঞয় সহজ নয়। মিতব্যয়ী ব্যক্তি অর্থ ব্যয়ে পরিমিরি।পরিচয় দিয়ে থাকেন। ফলে প্রতি মাসে তার আয় সামান্য হলেও সয়ের সুযােগ থাকে। অমিতব্যয়ী ব্যক্তি সঞ্জয়ী মনােভাবের নন বলে জীবনের অনাকাঙ্ক্ষিত কোনাে দুর্ঘটনা বা দুর্দিনে তার কাছে অর্থ থাকে না। ফলে বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। তাই ব্যক্তিজীবনে সঞ্চয়ের প্রয়ােজনকে স্বীকার করতে হবে। আর সঞ্চয় কেবল তার পক্ষেই সম্ভব যে মিতব্যয়ী। মানবজীবনে মিতব্যয়িতাকে ধারণ করতে হবে স্বভাবধর্ম হিসেবে, তবেই সম্ভব সঞয় ও সমৃদ্ধি।

মিতব্যয়িতার প্রয়োজনীয়তা:

মানবজীবনে মিত্যব্যয়িতার প্রয়োজন অনিবার্য বলা চলে। কেননা সম্পদের সঠিক ও সঙ্গত ব্যয়ের মধ্যে সুখ ভােগ নিহিত। আজকে যে মানুষ উপার্জনক্ষম সে একদিন উপার্জনে অক্ষম হবে। তরুণ বয়সে যে পরিশ্রম করা যায় তা বার্ধক্যে অসম্ভব। অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে দিনযাপন করা গৌরবের বিষয় নয়। তাই স্বনির্ভর জীবন নিশ্চিত করতে হলে মানুষকে মিতব্যয়ী হয়ে ভবিষ্যতের জন্যে কিছু সঞয়কে করতে হবে । বিত্তবান মানুষ মিতব্যয়ী হলে সমাজে তার দ্বারা নানারকম উন্নতি সাধিত হয়। অযথা অকারণে অপচয় না করে তিনি যদি স্কুল, কলেজ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, রাস্তাঘাট ইত্যাদি নির্মাণ করেন তাহলে জনকল্যাণ হয় । মধ্যআয়ের সাধারণ মানুষের জীবনেও মিতব্যয়িতার বিশেষ প্রয়ােজন। কেননা জীবনে শেষের দিনগুলাে সুখের করতে হলে তাকে মিতব্যয়ী হতে হবে। ব্যক্তির ব্যক্তিগত মিতব্যয়িতা বৃহৎ অর্থে জাতির জাতীয় মিতব্যয়িতা। বিশ্বে যে জাতি যত মিতব্যয়ী সে জাতি তত স্বনির্ভর ও মর্যাদাবান। তাই ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে মিতব্যয়িতা প্রয়ােজন।

মিতব্যয়িতা কার্পণ্য:

মিতব্যয়িতা ও কৃপণতা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। সমাজে অনেকে আছেন যারা শতভাগ কৃপণ অথচ তারা। নিজেদের দাবি করেন মিতব্যয়ী হিসেবে । কৃপণ ব্যক্তি তার সম্পদকে আঁকড়ে ধরে রাখেন। পক্ষান্তরে, মিতব্যয়ী ব্যক্তি সম্পদ আঁকড়ে ধরে না রেখে সঠিক পথে সঠিক সময়ে ব্যয় করেন। সম্পদের ব্যয়ে তার আপত্তি নেই, আপত্তি আছে অপচয়ে এবং অর্থের অব্যবহারে । কৃপণ ব্যক্তি অর্থ ব্যয় করে চিকিৎসা করান না এমন উদাহরণও সমাজে চোখে পড়ে। এ দিক থেকে বিবেচনা করলে বলা যায়, কৃপণ ব্যক্তির কাছে অর্থের মূল্য জীবনের চেয়েও বেশি। পক্ষান্তরে, মিতব্যয়ী ব্যক্তি কিছু অর্থ বসময়ই বরাদ্দ করে রাখেন রােগে-শােকে যেন কাজে লাগানাে যায় । মিতব্যয়ী ব্যক্তি কারও প্রয়ােজনে সহযােগিতা করতে পারেন কিন্তু কৃপণ ব্যক্তির পক্ষে তা অসহজ। তাই মিতব্যয়িতা চর্চা করা মানে কৃপণতা নয়, আবার কৃপণতা মানেও মিতব্যয়িতা নয়। তাই আমাদের কার্পণ্য করা উচিত নয়, হওয়া উচিত মিতব্যয়ী

অমিতব্যয়িতার পরিণাম:

অমিতব্যয়ী ব্যক্তি অতিরিক্ত ব্যয় করতে চায়। অতিরিক্ত ব্যয় করতে যেয়ে অতিরিক্ত অর্থের প্রয়ােজন হয়। তার ফলে অতিরিক্ত অত্যাচারী হয়ে ওঠা তার পক্ষে খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। অন্যায়ভাবে অর্থ উপার্জন না করলে প্রচুর টাকা হাতে।ধরা দেয় না, তাই অমিতব্যয়ী ব্যক্তি হয়ে ওঠে অসংযমী। অমিতব্যয়ী ব্যক্তির জীবনে স্থিতিশীলতা থাকে না, ফলে সমাজজীবনে সে। অগোছালাে হয়ে পড়ে। অমিতব্যয়ী ব্যক্তি স্বভাবগত ভাবেই নিয়ন্ত্রণহীন। প্রচুর অর্থ তার চাই । অর্থের বিপুল বাসনা তাকে পাপের দিকে টানে। অমিতব্যয়ী ব্যক্তি নিয়ত অপব্যয়ী। অপব্যয়ের পরিণতির দিকে ইঙ্গিত করতেই কবি বলেছেন- যে জন দিবসে মনের হরষে।

জ্বালায় মোমের বাতি আশু গৃহে তার দেখিবে না আর নিশীথে প্রদীপ ভাতি।’

মিতব্যয়িতা আজকের সমাজ:

আজকের সমাজে মিতব্যয়িতা চর্চা হ্রাস পেয়েছে আশঙ্কাজনকভাবে । মিতব্যয়িতা চর্চা হচ্ছে। বলেই অতিরিক্ত পাবার বাসনা থেকে বৃদ্ধি পাচ্ছে দুর্নীতি, ঘুষ, চাঁদাবাজি ইত্যাদি। একজনের বিপুল অর্থকে অতিক্রম করার চেষ্টা করছে অন্যজন । উঁচুতে ওঠার প্রতিযােগিতা মানুষকে করে তুলছে মূল্যবােধহীন। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সমাজে,বিশেষ করে তরুণ সমাজে । মিতব্যয়িতা চর্চাই পারে আজকের সমাজকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে ।

উপসংহার:

মিতব্যয়িতা চর্চা হিতকর, পক্ষান্তরে অমিতব্যয়িতা ক্ষতিকর। মিতব্যয়িতা মানব জীবনের একটি উত্তম গুণ। এ গুণটি যত বেশি মানুষের মধ্যে কার্যকর হবে তত বেশি শান্তি ও সমৃদ্ধির সাক্ষাৎ পাবে মানুষ । একটি সমৃদ্ধিশীল সমাজ ও দেশ গঠনে তাই মিতব্যয়িতার প্রয়ােজন অনস্বীকার্য।

শৃঙ্খলাবোধ রচনা

  • ভূমিকা
  • শৃঙ্খলা কী
  • শৃঙ্খলা ও প্রকৃতি
  • ছাত্রজীবনে শৃঙ্খলাবোধ
  • সমাজ ও জাতীয় জীবনে শৃঙ্খলা
  • শৃঙ্খলাবোধের গুরুত্ব
  • শৃঙ্খলাহীনতার পরিণাম
  • উপসংহার

ভূমিকা:

মানুষ দৈনন্দিন জীবনে নিয়মের অনুবর্তী হয়ে যে কাজ সম্পাদন করে তাই শৃঙ্খলা বা নিয়মানুবর্তিতা। আর শৃঙ্খলাকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ এবং চর্চার মধ্য দিয়েই জন্ম হয় শৃঙ্খলাবােধের। শৃঙ্খলাবােধ মানবজীবনের একটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য, যা জীবনের সবকিছুকেই সার্থক করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে শৃঙ্খলাবোেধ বয়ে আনে শান্তিময় স্বাভাবিক জীবন।

শৃঙ্খলা কী:

নিয়ম-কানুনের প্রতি আন্তরিক আনুগত্য এবং তা অনুসরণ করাই শৃঙ্খলা । শৃঙ্খলা এবং শৃঙ্খলাবােধ শুধু রাষ্ট্রীয় কিছু বিধি নিষেধকে গ্রহণ বা বর্জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রেই অলিখিত কিছু রীতি আছে যা মানুষকে মেনে চলতে হয়। জগতের সকল কাজের সাথেই শৃঙ্খলা জড়িত এমনকি বিশ্বজগতের বিস্তৃত প্রকৃতির মধ্যেও শৃঙ্খলার বিষয়টি স্পষ্ট। ঘরে, বাইরে, রাষ্ট্রে ও প্রকৃতিতে যেখানেই শৃঙ্খলার ব্যতিক্রম হয়েছে সেখানেই বিপর্যয় ঘটেছে। শৃঙ্খলাবােধ মানুষের আনুগত্যের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ ।

শৃঙ্খলা প্রকৃতি:

বিশ্ব প্রকৃতির সকল ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা বিদ্যমান। চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ তারা স্বকিছুই চলছে নিয়মের মধ্য দিয়ে। পৃথিবী তার কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান এমনিভাবে নিয়মকে অনুসরণ করছে অন্যান্য গ্রহ-নক্ষত্র। পাহাড় বেয়ে ঝরনা নামে, ঝরনা মিলিত হয় নদীতে আর নদী ছােটে সমুদ্রের পানে এর মধ্যেও আছে প্রকৃতির চিরকালীন নিয়ম । নদীর জলে জোয়ার আসে, আসে ভাটাও। বর্ষা আসে, শীত আসে, আসে বসন্ত। পৃথিবী আঁধার করা অমাবশ্যা কালাে পর্দা টেনে দেয় জগৎ-সংসারে। দুনিয়ার সবকিছুকে যেন আড়াল করে দেয়। আবার পূর্ণিমা আসে। কোমল আলােয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে গােটা জগৎ। এ সবই নিয়মশৃঙ্খলাকে মান্য করেই ঘটছে। এর ব্যতিক্রম ঘটলেই ছন্দপতন ঘটবে পৃথিবীর। মানুষ হারাবে স্বাভাবিক জীবন। শ্বাপদসংকুল অরণ্যে প্রাণিজগতেও আছে শৃঙ্খলা। তাদের আহার, বিহার, বাসস্থান সবকিছুতে যদি শৃঙ্খলা না থাকত তাহলে বনের প্রাণীরা নেমে আসত হাট-বাজারে, পাখিরা গান গাইত কোনাে কনসার্টে।

ছাত্রজীবনে শৃঙ্খলাবোধ:

মানুষ জীবনে যা কিছু শেখে, যা কিছু অর্জন করে এর প্রাথমিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করে ছাত্রজীবন। ছাত্রজীবনে শৃঙ্খলাবোধ না থাকলে জীবন শেষে কোনাে প্রাপ্তিই তার জুটবে না। শৃঙ্খলাবােধ মানুষকে সুনিয়মে চালিত করে বলে ছাত্রজীবনে এর চর্চা থাকলে কোনাে ছাত্রের জীবনেই অনিয়ম ও উচ্ছশৃঙ্খলতা প্রবেশ করে না। পক্ষান্তরে, যে ছাত্র নিয়মের অনুবর্তী নয় তার পক্ষে যথাসময়ে যথা কাজ করা অসম্ভব। ফলে পিছিয়ে যেতে যেতে ছাত্রের মনে এক ধরনের নেতিবাচক ধারণার জন্ম হয়। সে উদ্যম হারিয়ে নিজের জীবনকে অর্থহীন করে তােলে এমনকি বিপথগামী হওয়াও তার পক্ষে সহজ। শৃঙ্খলা নেই এমন ছাত্র ছাত্রমহলে এবং শিক্ষকমহলে সমাদৃত হয় না। পক্ষান্তরে, শৃঙ্খলাবোধে উজ্জীবিত ছাত্র-শিক্ষকের স্নেহ আনুকূল্য এবং পৃষ্ঠপােষকতা লাভ করে জীবনকে উন্নত করার সুযােগ পায় । তাই ছাত্রজীবনেই শৃঙ্খলাবোধে জাগ্রত হওয়া জরুরি।

সমাজ জাতীয় জীবনে শৃঙ্খলা:

মানুষের সমাজিক জীবন একটি সংঘবদ্ধ জীবন। সংঘবদ্ধ জীবনে শৃঙ্খলার প্রয়ােজন। একটি সমাজে শৃঙ্খলা না থাকলে এর সুন্দর কাঠামােটি ভেঙে পড়ে। সমাজজীবনে নিয়ম শৃঙ্খলার অভাব ঘটলে একটি উচ্ছল গােত্রের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ফলে সমাজে অত্যাচার, লুণ্ঠন এবং অসামাজিক ক্রিয়াকলাপ বৃদ্ধি পায়। যেখানে নিয়ম শৃঙ্খলা নেই সেখানে যে কেউ স্বেচ্ছাচারিতা চর্চার সুযােগ পায় অনায়াসে। ফলে অপেক্ষাকৃত নিম্নবর্গের মানুষের ওপর ক্ষমতাবানদের ক্ষমতা চর্চার সুযােগ ঘটে। আর এ কারণেই সাধারণ মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। তাই সমাজ জীবনে শৃঙ্খলার প্রয়ােজনীয়তাকে অস্বীকার করার সুযােগ নেই। জাতীয় জীবনেও রয়েছে শৃঙ্খলাবােধের প্রয়ােজনীয়তা। রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের মধ্যে নিয়মকানুন মেনে চলার প্রবণতা না থাকলে রাষ্ট্র অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হয়। আর অকার্যকর রাষ্ট্র মানেই অরাজকতা এবং সীমাহীন দুনীতি। শৃঙ্খলাপূর্ণ জাতি খুব দ্রুত উন্নতির শিখরে আরােহণ করতে সক্ষম হয়। শৃঙ্খলাকে সভ্য সমাজের একটি লক্ষণ বলা যেতে পারে। তাই জাতির জাতীয় অগ্রগতির প্রয়ােজনে এবং সভ্য সমাজের বাসিন্দা হিসেবে আমাদের সকলের উচিত নিয়ম শৃঙ্খলাকে জীবনের অনিবার্য অনুষঙ্গ হিসেবে গ্রহণ করা।

শৃঙ্খলাবোধের গুরুত্ব:

মানুষ নিরন্তর সংগ্রামে গড়ে তুলতে চায় তার আকাঙ্ক্ষিত জীবন। জীবন আপনাআপনিই বিকশিত হয়।জীবনকে সফল পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে হলে চাই জীবনের জন্যে অনুকূল পরিবেশ। আর শৃঙ্খলা জীবনে বয়ে আনে। সে অনুকূল পরিবেশ। শৃঙ্খলা জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যায় সুন্দর আগামীর দিকে। শৃঙ্খলার গুরুত্বটি অনুধাবন সহজ হয়। সৈনিক জীবনের দিকে দৃষ্টিপাত করলেই। বিশাল সৈন্যবাহিনী যুদ্ধ বিগ্রহে কঠোরভাবে মেনে চলে শৃঙ্খলা। শৃঙ্খলা ভজা হলে। যুদ্ধের মাঠে পরাজয় অবধারিত হয়ে যায়। তাই সৈনিক জীবনের উদয়াস্ত সমস্তই শৃঙ্খলাপূর্ণ। বিশ্বের উন্নত দেশগুলাে প্রভূত উন্নতি করছে শৃঙ্খলাকে অবলম্বন করে। তাই ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে শৃঙ্খলার গুরুত্ব অপরিসীম।

শৃঙ্খলাহীনতার পরিণাম:

শৃঙ্খলাহীনতার পরিণাম অশান্তি। যে সমাজ শৃঙ্খলাবর্জিত সে সমাজের ধ্বংস অনিবার্য। শৃঙ্খলা নেই এমন সমাজে যে কেউ আইনকে তার নিজের হাতে তুলে নিতে বিলম্ব করে না। ফলে দুর্বল মার খায় সবলের হাতে। সীমাহীন। স্বেচ্ছাচারিতা সমাজের জন্যে বয়ে আনে অকল্যাণ। পৃথিবীর এমন রাষ্ট্রের উদাহরণ সহজেই দেয়া যায় যে রাষ্ট্রে শৃঙ্খলা চর্চা নেই। ফলে যুগ যুগ ধরে উন্নতির চেষ্টা করেও তারা উন্নতির সাক্ষাৎ পাচ্ছে না বরং দেশের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে পড়ছে চরমপন্থিদের বিদ্রোহ। শৃঙ্খলার প্রতি আনুগত্য নেই বলেই আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ নানা দেশের অর্ধেক শাসনভার সরকারের হাতে, অন্য অর্ধেক বিদ্রোহী চরমপন্থিদের হাতে। এ পরিস্থিতি সভ্য জাতির লক্ষণ হতে পারে না। তাই রাষ্ট্রের উচিত নিয়ম শৃঙ্খলা লজ্জিত হলে তার উপযুক্ত তদারকি করা যাতে জাতির চরম পরিণতি রক্ষা হয়। আইনশৃঙ্খলা অমান্যকারীদের আইনের আওতায় আনতে পারলেই জাতি ভয়াল পরিণতি থেকে রক্ষা পেতে পারে।

উপসংহার:

শৃঙ্খলাবোধ সম্পন্ন ব্যক্তির আচরণে সুনাগরিকের লক্ষণ প্রকাশ পায়। জীবনকে নান্দনিক পরিণতি দানে শৃঙ্খলা অনুশীলন অত্যাবশ্যক। সুনাগরিকের ব্যক্তি সাফল্য বৃহৎ অর্থে জাতীয় সাফল্যের নামান্তর। তাই জাতীয় জীবনে অগ্রগতি ও উন্নতি কাম্য হলে সবচেয়ে প্রয়ােজন শৃঙ্খলাবোধসম্পন্ন সুনাগরিকের।

শ্রমের মর্যাদা রচনা

  • ভূমিকা
  • শ্রমের মহিমা
  • শ্রমের গুরুত্ব
  • মানসিক ও শারীরিক শ্রম
  • ব্যক্তিজীবনে শ্রমের গুরুত্ব
  • সভ্যতা বিকাশে শ্রম
  • উপসংহার

ভূমিকা:

মানবসভ্যতার সকল সৃষ্টির মূলেই রয়েছে শ্রম । আজকের সভ্যতা যুগ-যুগান্তরের অগণিত মানুষের নিরলস শ্রমের ফসল । জীবনধারণের তাগিদেই মানুষ কর্মব্যস্ত। তাকে শ্রমের মাধ্যমেই তার চাহিদা পূরণ করতে হয়। গুহাবাসী মানুষ একমাত্র শ্রমের মাধ্যমেই বর্তমানের এ উন্নত সভ্যতার জন্ম দিয়েছে। কৃষকের ফসল উৎপাদন, শিল্পীর শিল্পকর্ম, জ্ঞানীর জ্ঞানার্জন, মহাশূন্যে নভােচারীর দুঃসাহসিক অভিযান, সমুদ্রের তলদেশ হতে ডুবুরির দুঃসাহসিক তথ্য আহরণ, বিজ্ঞানীর নব নব অত্যাশ্চর্য আবিষ্কার সবই শ্রমলব্ধ ফসল। মানবজীবনের সবক্ষেত্রেই যা কিছু দৃশ্যমান তা সবই পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে।

শ্রমের মহিমা:

জন্মগতভাবেই মানুষ কিছু না কিছু সুপ্ত প্রতিভার অধিকারী। আর এ সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ একমাত্র শ্রমের মাধ্যমেই সম্ভব। মানুষ নিজেই তার ভাগ্যনির্মাতা। পরিশ্রমের মাধ্যমেই মানুষ নিজের ভাগ্য গড়ে তােলে। ইতিহাসলব্ধ জ্ঞান থেকে আমরা দেখতে পাই, যে সকল মানুষ পৃথিবীতে স্মরণীয়-বরণীয় তাঁদের সাধনাই ছিল পরিশ্রম। তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমের সাফল্যেই মানবসভ্যতা সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর হয়েছে। উন্নত দেশগুলাের দিকে তাকালে দেখা যায়, তাদের উন্নতি পরিশ্রমেরই অবদান। যে জাতি শ্রমকে মূল্য দিতে পেরেছে, সে জাতিই জগতে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে। কঠোর পরিশ্রমই। তাদের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের মহিমা দিয়েছে।

শ্রমের গুরুত্ব:

মানবজীবন ও মানবসভ্যতার উন্নতির জন্যে প্রতিটি ক্ষেত্রে শ্রম অপরিহার্য উপাদান। মানুষের জন্ম তার নিজের অধীন নয়, কিন্তু কর্ম নিজের অধীন। এজন্যেই বলা হয় “জন্ম হােক যথা তথা কর্ম হােক ভালাে’, কারণ কমই পারে মানুষকে সাফল্যের স্বর্ণশিখরে পৌছে দিতে। শ্রমের মাধ্যমেই মানুষ জীবন সংগ্রামে জয়ী হতে পারে। অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতি মােকাবিলা করে মানুষকে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হয়। এসব ক্ষেত্রে পরিশ্রমই তার একমাত্র হাতিয়ার। তাই ব্যক্তিজীবনে এবং সমাজে শ্রমের যথাযথ মর্যাদা ও স্বীকৃতি দিতে হবে। সমাজে বিভিন্ন স্তরে শ্রমের পার্থক্য থাকলেও কোনােটার গুরুত্বই কম নয়। সামাজিক প্রয়ােজনীয়তা অনুযায়ী প্রতিটি স্তরের শ্রমই সমান গুরুত্বপূর্ণ। কৃষক, মজুর, শিক্ষক, ডাক্তার, শিল্পী, বিজ্ঞানী, রাষ্ট্রনায়ক প্রত্যেকের যথাযথ পরিশ্রমই সমাজ ও দেশের অগ্রগতি সাধন করে। তাই মানবজীবনে শ্রমের গুরুত্ব অপরিসীম।বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছেন, ‘… a hard working street cleaner is a better man than a lazy scholar.’ শ্রমই মানুষকে সৃজনশীল করে। নব নব সৃজনের মাধ্যমে মানুষ নতুন অগ্রগতি সাধন করে। আজকের দিনের মানুষের শ্রমসাধিত কর্ম আগামী দিনের মানুষকে নতুন কর্মে উজ্জীবিত করে। এককথায়, মানুষকে যথাযথ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত ক্রা এবং কাল থেকে কালান্তরে অমর করে রাখার একমাত্র উপায় শম। শ্রমবিমুখ তথা কর্মবিহীন ব্যক্তি মৃত্যুর সাথে সাথেই পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যায়। অন্যদিকে শ্রমের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মানুষ ইতিহাসের পাতায় বেঁচে থাকে চিরদিন। অর্থাৎ মানুষ বেল। প্রাত্যহিক জীবনযাপনেই বাঁচে না। সশ্রমের শক্তিতেই বাঁচে।

মানসিক শারীরিক শ্রম:

সকল কাজের সাফল্য প্রাপ্তির জন্যে মানসিক ও শারীরিক পরিশ্রমের ভূমিকা অনস্বীকার্য। মানসিক পরিশ্রম মানসিক উন্নতি দান করে এবং নবসৃষ্টির, নবচিন্তার জন্ম দেয়। আর মানসিক শ্রম যে কাজের চিন্তা করে শরীরিক শ্রম তা সম্পাদন করে। তাই সকলকেই এ উভয় শ্রমের মর্যাদাকে স্বীকার করতে হবে। জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভের ক্ষেত্রে উভয়। শ্রমই সমান গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কার্যত আমরা দেখি, মানসিক পরিশ্রমের মর্যাদা মানুষ স্বীকার করলেও শারীরিক পরিশ্রমকে অনেকেই অবজ্ঞার চোখে দেখে । ফলে সামাজিক ক্ষেত্রে দেখা যায়, শিক্ষক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ প্রমুখ পেশাজীবী মানুষের অবস্থান সমাজের উপরতলায় । অন্যদিকে কুলি-মজুর-কৃষক-শ্রমিক এদের অবস্থান সমাজের নীচুতলায় । অন্নহীন, বস্ত্রহীন, শিক্ষাহীন মানবেতর জীবনই তাদের নিত্যসঙ্গী। যদিও শারীরিক শ্রম সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভের উপায়, আত্মসম্মানের পরিপন্থি নয়। প্রতিটি মানুষই দেশ ও জাতির কল্যাণ করার উদ্দেশ্যে নিজ যােগ্যতা অনুসারে মানসিক কিংবা শারীরিক শ্রমকে অবলম্বন করছে। তাই উভয় পরিশ্রমই মর্যাদার। মানসিক শ্রম যেমন ব্যক্তিমনে সুচিন্তা ও সদ্ভাব জন্ম দেয়, তেমনি শারীরিক শ্রমজীবী মানুষ সমাজ ও দেশকে সুন্দর ও কল্যাণকর করার প্রয়াসী হয়। এদের অবদান স্বীকার করে কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন–

‘গাহি তাহাদের গান —

ধরণীর হাতে দিল যারা আনি’ ফসলের ফরমান।

শ্রম কিনাঙ্ক-কঠিন যাদের নির্দয় মুঠি-তলে

ত্ৰস্তা ধরণী নজরানা দেয় ডালি ভরে ফুলে ফলে।’

ব্যক্তিজীবনে শ্রমের গুরুত্ব:

শ্রমবিমুখ ব্যক্তি কখনােই জীবনকে সুন্দর করে গড়ে তুলতে পারে না। সামাজিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হতে হলে প্রত্যেক ব্যক্তিকেই শারীরিক ও মানসিক শ্রমকে সমান মূল্য দেয়া উচিত। অন্যথায় জীবনে নেমে আসে অভিশাপ। বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিদের জীবন পর্যালােচনা করলে আমরা দেখতে পাই, নিরলস শ্রম সাধনাই তাদের সাফল্যের একমাত্র কারণ। সমষ্টিগত জীবনকে সুন্দর ও মহিমাময় করতে শ্রমের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। কিন্তু ব্যক্তিজীবনে শ্রমের গুরুত্ব আরও গভীর ও ব্যাপক। কেননা শ্রমন্মুিখ ব্যক্তি সাফল্যের ছোঁয়া থেকে চিরকালই বঞ্চিত। পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর পত্রিকার পাতায় ফুটে ওঠে এমন অনেক ছাত্রের ছবি, যাদের আর্থিক সংগতি শূন্যের কোটায়। তবুও একমাত্র কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমেই তারা। পরীক্ষায় অসাধারণ সাফল্য অর্জন করছে। দৈহিক ও মানসিক পরিশ্রমের ফলেই তারা জীবনকে সুন্দর করে তুলছে। একইভাবে ইতিহাসবিখ্যাত ব্যক্তি জর্জ ওয়াশিংটন, আব্রাহাম লিঙ্কন, আলবার্ট আইনস্টাইন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাক্সিম গাের্কি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখ ব্যক্তির জীবন থেকেও আমরা একই শিক্ষা গ্রহণ করি। শ্রমবিমুখত ব্যক্তিকে ব্যর্থতার গ্লানিতে পর্যবসিত করে, তার অগ্রগতির পথকে করে রুদ্ধ। তাই ব্যক্তিজীবনের সাফল্য শ্রমেরই সাফল্য।

সভ্যতা বিকাশে শ্রম:

মানবসভ্যতার বুনিয়াদ তৈরি করেছে শ্রম। একদিন গুহাবাসী মানুষ জীবন সংগ্রামের তাগিদে পাথরের নুড়ি দিয়ে শ্রমের সাহায্যে হাতিয়ার তৈরি করতে শিখেছিল। তারপর লক্ষ-কোটি মানুষের তিল তিল শ্রমে গড়ে উঠেছে। আজকের সভ্যতার বিজয়স্তম্ভ। মানুষ যদি নিষ্কর্মা হয়ে ভাগ্যের হাতে আত্মসমর্পণ করে বসে থাকত তাহলে আমাদের সামনে এ সমুন্নত সভ্যতার বিকাশ হতাে না । শ্রমের শক্তিতেই মানুষ নতুন নতুন সামাজ্যের পত্তন করেছে, করেছে সভ্যতার ক্রমবিস্তার। শ্রম ব্যক্তিজীবনকে সমৃদ্ধ ও ঐশ্বর্যশালী করে তারই প্রভাব পড়ে সমাজজীবনের ওপর। তাই শুধু ব্যক্তিজীবনের বিকাশ নয়, সভ্যতার বিকাশেও শ্রমই হাতিয়ার। বিষপানে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, যে জাতি যত বেশি পরিশ্রমী সে জাতি তত বেশি উন্নত। রাশিয়া, চীন, আমেরিকা, জার্মানি, জাপান প্রভৃতি দেশ শ্রমের প্রক্রিয়াতেই এত বেশি উন্নত। যুগ যুগ ধরে মানুষের কঠোর শ্রমই পৃথিবীকে বাসযােগ্য করেছে, সভ্যতাকে করেছে সমৃদ্ধ একবিংশ শতাব্দীর উন্নত ও প্রগতিশীল সভ্যতাও মানুষের নিরলস শ্রমের ফসল।

উপসংহার:

পৃথিবী সৃষ্টি থেকে বর্তমান পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে শ্রমের অবদান অপরিসীম। ব্যক্তিজীবন থেকে জাতীয় জীবনের কাঙ্ক্ষিত সাফল্য একমাত্র শ্রমশক্তির মাধ্যমেই সম্ভব। তাই দেশের জন্য, মাজের জন্য অবস্থান ও দক্ষতা অনুযায়ী যে পরিশ্রমই করা হোক না কেন তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। সব শ্রেণির শ্রমকে যদি সমান মর্যাদা দেয়া হয় তবেই দেশ ও জাতির যথার্থ কল্যাণ সাধিত হবে। সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশের জন্য সব ধরনের শ্রমই প্রয়ােজনীয়— এ বােধই পারে সব ধরনের শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলােতে শ্রমের এবং শ্রমজীবী মানুষের অধিকার ও মর্যাদা স্বীকৃত। আমাদের দেশের উন্নতিও এ মূল্যবােধের মাধ্যমে সম্ভব।

সময়ের মূল্য

  • ভূমিকা
  • সময়ানুবর্তিতা কী
  • সময়ানুবর্তিতার প্রয়োজনীয়তা
  • সময়ানুবর্তী না হওয়ার পরিণাম
  • সময়ের সদ্ব্যবহার
  • সময়ের মূল্যায়ন ও জীবনে সাফল্য
  • সময়নিষ্ঠ ব্যক্তি ও জাতির উদাহরণ
  • উপসংহার

ভূমিকা:

একটি সফল জীবনের যে চরিত্রগুণ থাকে তার মধ্যে সময়ানুবর্তিতার মতাে উত্তম গুণটিও বিদ্যমান থাকে। বিচিত্র কর্মপ্রবাহে বিকশিত জীবন অর্থবহ করে তােলার অন্যতম প্রধান উপায় হিসেবে ময়ানুবর্তিতাকে বিবেচনা করা চলে।সময়ানুবর্তিতাকে পরিত্যাগ করে মনুষ্যজীবন কৃতকার্যময় হয়ে উঠতে পারে না নিজের সম্ভাবনা বা প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে চাইলেও সময়ানুবর্তী হতে হবে, কেননা সময়ের সঠিক এবং সফল ব্যবহারই মানুষকে যথা সময়ে যথা কাজটি সম্পাদনে সহায়তা করে। তাই সময়ের অনুবর্তী হতে পারলেই জীবনকে সফল করে তোলা সম্ভব।

সময়ানুবর্তিতা কী:

মানবজীবনের প্রতিটি মুহূর্ত একটা বিশেষ কর্তব্যের আহ্বান নিয়ে আমাদের মাঝে উপস্থিত হয়। প্রতিটি আহ্বানে সাড়া দিতে হলে সময়ের কাজ সময়ে সমাপ্ত করতে হবে। সময়ের কাজ সময়ে সম্পাদনের উদ্যোগকেই সময়ানুবর্তিতা বলে। যে সময় যে কর্তব্যের ডাক আসে ঠিক তখনই তা না করলে ঐ মুহূর্তটি নিষ্ফল হয়ে যায়। সংসারে কাজের জন্য নির্ধারিত সময়ে বিশেষ কাজটি সম্পাদন করাতেই সময়ানুবর্তিতার প্রকাশ ঘটে। দ্রুত চলমান সময়ের মহাকালের মধ্যে মানবজীবনকে কল্পনা করতে গেলে মানবজীবন অতি সামান্য বলেই বিবেচিত হয়। এ সামান্য জীবনই অসামান্য গৌরবকে ধারণ করতে পারে যদি জীবনে থাকে সময়ানুবর্তিতা । বলা চলে, সময়ানুবর্তিতাই হচ্ছে জীবনে সাফল্যের একটি সিড়ি।

সময়ানুবর্তিতার প্রয়োজনীয়তা:

যে জীবন সফলতার জন্যে উন্মুখ সে জীবনে সময়ানুবর্তিতার প্রয়ােজন সর্বাধিক। যার জীবনে। সময়ানুবর্তিতা নেই তার জীবনে সফলতার আশা করা বৃথা । অনন্ত কালপ্রবাহে মানুষ বেঁচে থাকে তার সুকীর্তির মধ্য দিয়েই। সুকীর্তি নির্মাণ তার পক্ষেই কেবল সম্ভব যার পক্ষে সময়ানুবর্তী হওয়া সম্ভব। মানুষ পৃথিবীকে সভ্যতার উচ্চশিখরে আজ আসীন করতে পেরেছে সময়ানুবর্তিতা চর্চার মাধ্যমেই। কবি বলেছেন–

‘নদী আর কালগতি উভয়ে সমান

অস্থির প্রবাহে করে উভয়ে প্রয়াণ।

তাই সময়ের এ প্রবহমান ধারা থেকে সময়কে সঠিকভাবে কাজে লাগানাের মধ্যে জীবনের সাফল্য নির্ভর করে। সময়ানুবর্তিতার মধ্যে মানবজীবনের কৃতিত্ব নিহিত। ঘাসের ডগায় চিকচিক করা শিশিরের মতাে মানবজীবন- যে জীবন প্রভাতেই মিলিয়ে যায় সূর্যের প্রথম সাক্ষাতে। তাই ক্ষণস্থায়ী এ জীবনকে একটি চিরস্থায়ী সম্মানিত আসনে রেখে যেতে হলে প্রয়ােজন সময়ের অনুবর্তী হওয়া।

সময়ানুবর্তী না হওয়ার পরিণাম:

মানুষ সময়ানুবর্তী না হলে জীবনে দুঃখ-যাতনার অন্ত থাকে না। সময়ানুবর্তী না হওয়া আলস্যপূর্ণ জীবনেরই নামান্তর। জীবনের লক্ষ্য অর্জনে সময়ানুবর্তিতার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। এর ব্যতিক্রম হলে পরিণাম হবে দুঃখময় । যে সব জাতি আজ বিশ্বের সভ্য দেশ এবং উন্নত জাতি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে তারা ছিল সময়ানুবর্তী। অন্যদিকে, পৃথিবীতে যেসব জাতি এখনও পশ্চাৎপদ তাদের ইতিহাস পর্যালােচনা করলে দেখা যায়, তারা সময়ানুবর্তিতা চর্চা করেনি। তাই তাদের পরিচিতিও হয়েছে অনুন্নত জাতি হিসেবে।

সময়ের সদ্ব্যবহার:

এ জগৎ-সংসারের অনেক কিছুরই আর্থিক মূল্য নিরূপণ করা যায় । কিন্তু সময়ের মূল্য নিরূপণ করা সম্ভব নয় । জন্ম ও মৃত্যুর শাসনে জীবন সদা সংকুচিত। আশা করলেও মানুষ অন্তহীন জীবন পায় না। এখানেই জীবনের চরম ট্রাজেডি। কবি সুইনবার্গ বলেছেন—

‘life is a vision or a watch between a sleep and a sleep.’

দুই প্রান্তের ঘুম, ঘুমের মতো অন্ধকার, মাঝখানে একটু চেয়ে থাকাটা জীবন। তাই জীবন যখন এতই অল্প সেজন্যই জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে সময়ের সদ্ব্যবহার করতে হবে। সময়ের সদ্ব্যবহারই নশ্বর পৃথিবীতে মানুষকে অবিনশ্বর করে বাঁচিয়ে রাখে। বিশ্বে বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক, দেশনায়ক, গবেষকসহ সকল কীর্তিমানবরাই সময়ের সদ্ব্যবহার করেছেন। ছাত্রজীবনেও সময়ের সদ্ব্যবহার করলে।

জীবন গঠন সহজ হয়।

সময়ের মূল্যায়ন জীবনে সাফল্য:

সময়ের মূল্যায়নের সাথে জীবনের সাফল্য জড়িত। জীবনে সময়কে যথার্থ মূল্যায়ন করতে পারলে সফল হওয়া যায়। অন্যদিকে, সময়কে অবহেলা করে অপব্যয় করলে জীবনে ভয়াবহ পরিণতি নেমে আসে। কোনো বিষয়ে সে সফতার মুখ দেখতে পায় না। কবির ভাষায়—

‘নিতান্ত নির্বোধ শুধু সেইজন

অমূল্য সময় করে বৃথায় যাপন।’

সময়নিষ্ঠ ব্যক্তি জাতির উদাহরণ:

পৃথিবীর প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিদের জীবন পর্যালোচনা থেকে জানা যায়, তাদের কেউ সময়ের মূল্য সম্পর্কে উদাসীন ছিলেন না। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ছিল তাদের প্রাণচঞ্চল এবং কর্মবহুল । গণতন্ত্রের প্রবক্তা আব্রাহাম লিংকন- যিনি সামান্য শ্রমিক থেকে হয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের কৃতী প্রেসিডেন্ট। অ্যারিস্টটল যিনি দিগ্বিজয়ী বীর আলেকজান্ডারের গৃহশিক্ষক থেকে হয়েছিলেন জগদ্বিখ্যাত দার্শনিক। বৈজ্ঞানিক নিউটন, আইনস্টাইন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এমন মহামনীষীরা সময়নিষ্ঠ ছিলেন না এরূপ কথা শোনা যায়নি। আর সময়নিষ্ঠ জাতি হিসেবে ইংরেজ, আমেরিকান, জাপানি, ভিয়েতনামি, চাইনিজ ও কোরিয়ানদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। ইংরেজরা সময়নিষ্ঠ জাতি বলেই একসময় গোটা পৃথিবীতে সাম্রাজ্য গড়তে পেরেছিল। সময়কে কাজে লাগিয়েই জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষতচিহ্ন মুছে নিয়ে এখন উন্নত দেশ। আমাদের নিকট থেকে খুব দূরের দেশ নয় সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া। তারা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি সময়নিষ্ঠ বলেই প্রভূত উন্নতি তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে।

উপসংহার:

মানুষের জীবন দ্বিতীয়বার পৃথিবীতে আসবে না। তাই মানুষের উচিত এ জীবনকে পরিপূর্ণ করে গড়ে তোলা।এজন্য সময়ানুবর্তিতা একান্ত প্রয়ােজন । সময়ানুবর্তী জীবন উজ্জ্বল জীবনের উপমা ।

স্বদেশপ্রেম রচনা

  • ভূমিকা
  • স্বদেশপ্রেমের স্বরূপ
  • স্বদেশপ্রেমের প্রকাশ
  • স্বদেশপ্রেমের উপায়
  • স্বদেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত
  • স্বদেশপ্রেম ও বিশ্বপ্রেম
  • উপসংহার

ভূমিকা:

মা, মাটি, দেশ— এ তিনের সাথে মানবমনের রয়েছে অবিচ্ছেদ্য বন্ধন। এ তিনকে নিবিড়ভাবে ভালােবাসার মধ্যেই নিহিত আছে দেশপ্রেম। বিশাল পৃথিবীর যে সুনির্দিষ্ট ভৌগােলিক অংশে মানুষ জন্মগ্রহণ করে তাই তার স্বদেশ, তার মাতৃভূমি । মানুষ তার স্বভাবজাত গুণে অনিবার্যভাবে স্বদেশের মাটি, পানি, বায়ু অর্থাৎ সবকিছুর সাথে অনুভব করে নাড়ির টান, স্বদেশ হয়ে ওঠে তার কাছে সবচেয়ে পবিত্রভূমি এবং স্বদেশের প্রতি মনে জাগে অনন্য ভালােবাসা। দেশমাতৃকার প্রতি মানুষের এ অনুভব ও ভালােবাসাই হলাে স্বদেশপ্রেম ।

স্বদেশপ্রেমের স্বরূপ:

জন্মভূমির প্রতি মানৰ্মনের আবেগময় অনুরাগ মানুষের চিরন্তন বৈশিষ্ট্য। জন্মভূমির আলাে-বাতাস, পানি, ফসল মানুষকে মায়ের মমতা দিয়ে বড় করে তােলে। তার ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এককথায় স্বদেশের নানা উপাদান মানবমনের বিকাশের মাধ্যমে করে তােলে পরিপুষ্ট। তাই স্বদেশ ও স্বজাতির প্রতি মানুষের মনে জন্ম নেয় আত্মার গভীর টান এবং চিরায়ত অকৃত্রিম ভালােবাসা। যে অনুভূতি, যে ভালােবাসা দেশের কল্যাণে প্রয়ােজনে আত্মবিসর্জনে উদ্বুদ্ধ করে। দেশের প্রতি গভীর অনুরাগ মানুষের হৃদয়ে জন্মদাত্রী আর জন্মভূমিকে এক করে ভাবতে শেখায়। এ তীব্র অনুরাগই ‘স্বদেশপ্রেম’। একজন দেশপ্রেমিকের কাছে তার দেশ চির পবিত্র, চির অরাধ্য এবং স্বর্গের চেয়েও গরীয়ান। তাই দেশ ক্ষুদ্র কিংবা দরিদ্র হােক, তাতে দেশপ্রেমিকের কিছু যায় আসে না। কেননা দেশ যেমনই হােক তা দেশপ্রেমিকের কাছে অমূল্য, অতুল্য। ফলে দেশকে রক্ষা করার জন্যে সে নির্দ্বিধায় করতে পারে জীবনদান। তাই তাে স্বদেশের প্রতি গভীর অনুরাগে কবিগুরু বলেছেন-

‘যে তােমায় ছাড়ে ছাড়ুক, আমি তােমায় ছাড়ব না মা,

আমি তােমার চরণ –

মা গাে, আমি তােমার চরণ করব শরণ, আর কারাে ধার ধারব না মা ॥

কে বলে তাের দরিদ্র ঘর, হৃদয়ে তাের রতনরাশি –

আমি জানি গাে তার মূল্য জানি, পরের আদর কাড়ব না মা।

স্বদেশপ্রেমের প্রকাশ:

স্বদেশের প্রতি ভালােবাসা মানবহৃদয়ে সর্বদাই বহমান। মনের গভীর অনুরাগ থেকে জন্ম নেয়া স্বদেশপ্রেম প্রকাশ পায় বিশেষ সময়ে বিশেষ পরিস্থিতিতে বিচিত্র কার্যকলাপের মাধ্যমে। বিশেষত দেশ ও জাতির দুর্দিনেই স্বদেশপ্রেমের পূর্ণ প্রকাশ ঘটে। দেশ ও জাতির কল্যাণ সাধনের মাধ্যমেই দেশের প্রতি ভালােবাসার উৎসারণ ঘটে।দেশপ্রেমের আবেগময় প্রকাশ ঘটেছে কবিগুরুর কবিতায়।

বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল –পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান ॥

বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান।।

বাঙালির পণ, বাঙালির আশা, বাঙালির কাজ, বাঙালির ভাষা। সত্য হউক, সত্য হউক, সত্য হউক হে ভগবান।

জাতীয় জীবনের দুঃসময়ে স্বদেশপ্রেম প্রবল হয়ে ওঠে। কোনাে বিদেশি অপশক্তি যখন দেশকে পরাধীনতার অন্ধকারে টেনে নিতে চায় তখন স্বদেশপ্রেমই মুক্তিতে সামিল হবার জন্যে জাতির মনে চেতনা জাগায়। দুর্বার প্রাণশক্তিতে স্বদেশের সম্মান রক্ষার জন্যে মানুষকে আত্মত্যাগের মহামন্ত্র শিক্ষা দেয়। দেশপ্রেম মানুষকে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে একই প্রাণের বন্ধনে আবদ্ধ করে। কারাে কাছে মাথা নত করা নয় বরং মাথা উঁচু করে সম্মানের সাথে বাঁচতে শেখায়। তাই দেশপ্রেমিক আপন দেশের মর্যাদা রক্ষার জন্যে সর্বস্ব ত্যাগ করতে প্রস্তুত হয়। দেশপ্রেম ধনী-দরিদ্র, ক্ষুদ্র বৃহৎ সব ধরনের ব্যবধান ঘুচিয়ে একই জাতি হিসেবে বেঁচে থাকার মহৎ শিক্ষা দান করে। স্বদেশপ্রেমের প্রকাশ ঘটে বিদেশের অপরিচিত পরিবেশে। বিদেশের মাটিতে নিজ দেশের মাটির গন্ধ না থাকায় মন হয়ে ওঠে চঞ্চল। স্বদেশের প্রকৃতি ও মানুষের সান্নিধ্য কামনায় মনে জাগে তীব্র আকুলতা। তাইতাে কবির কামনা-

এই বাংলার আকাশ-বাতাস।

এই বাংলার ভাষা

এই বাংলার নদী, গিরি বনে।

বাঁচিয়া মরিতে আশা।’

স্বদেশপ্রেমের উপায়:

শিক্ষা, যােগ্যতা ও অবস্থানের ভিন্নতাভেদে নানান মানুষ নানান অবস্থানে থাকে। কিন্তু প্রতিটি মানুষ স্বীয় অবস্থান থেকেই দেশের উপকার সাধন করতে পারে। ছােট থেকে বড় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই স্বদেশপ্রেমের পরিচয় দেওয়া যায়। দেশ ও জাতির কল্যাণসাধনের উদ্দেশ্যে কিছু করার মধ্যেই দেশপ্রেম নিহিত আছে তা ছােটই হােক আর বড়ই হােক। নিজের স্বার্থ, নিজের দৈন্যদশাকে তুচ্ছ করে দেশ ও জাতির বৃহত্তর কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করার মহান ব্রত গ্রহণ করতে হবে। অবস্থানভেদে কৃষক যেমন ফসল উৎপাদন করে দেশের কল্যাণ সাধন করতে পারেন। তেমনি একজন। শিল্পী কিংবা সাহিত্যিক শিল্প-সাহিত্য চর্চার মাধ্যমে বিশ্বদরবারে দেশের গৌরব বৃদ্ধি করতে পারেন। তবে স্বদেশপ্রেমের নামে উগ্র জাতীয়তাবােধ বর্জনীয়। কেননা অন্ধ স্বদেশপ্রেম এবং উগ্র জাতীয় চেতনা মানুষকে সংকীর্ণ করে বিরােধের জন্ম দেয়।

স্বদেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত:

যুগে যুগে অনেক বরেণ্য ব্যক্তি দেশ ও জাতির কল্যাণে জীবন উৎসর্গ করে স্বদেশপ্রেমের উজ্জ্বল। দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। সারা বিশ্বের মানুষ তাদের স্মরণ করে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালােবাসায়। তাঁদের দৃষ্টান্ত বর্তমান ও অনাগত কালের মানুষের জন্যে হয়ে থাকবে চিরন্তন প্রেরণার উৎস। এ উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যেসব দেশপ্রেমিক অমূল্য অবদান রেখেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন মহাত্মা গান্ধী, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, এ কে ফজলুল হক, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, চিত্তরঞ্জন দাশ, তিতুমীর প্রমুখ। তাছাড়া তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক পাশা, ইতালির গ্যারিবাল্ডি, রাশিয়ার লেনিন, আমেরিকার জর্জ ওয়াশিংটন, চীনের মাও সেতুং প্রমুখ দেশপ্রেমিক ব্যক্তিরা চির অম্লান হয়ে থাকবেন । আমাদের দেশের ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে আত্মবিসর্জিত অসংখ্য শহিদও আমাদের দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করবে চিরদিন। দেশের প্রতি এসব দেশপ্রেমিকের ভালােবাসা ইতিহাসে অম্লান ঔজ্জ্বল্যে ভাস্বর থাকবে চিরকাল ।

স্বদেশপ্রেম বিশ্বপ্রেম:

স্বদেশপ্রেম মূলত বিশ্বপ্রেমেরই ভিত্তি। বিশ্বভ্রাতৃত্ববােধের চেতনা সার করতে না পারলে প্রকৃত স্বদেশপ্রেম সম্ভব নয় । দেশ, দেশের মাটি ও দেশের মানুষকে ভালােবাসার মধ্য দিয়ে মানুষ বিশ্ববাসীকে ভালােবাসতে শেখে। স্বদেশপ্রেমের মাধ্যমে মানুষ সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠে বৃহত্তর প্রাণের মিলনে সাড়া দেয়। তাই প্রকৃত স্বদেশপ্রেম আর বিশ্বপ্রেমের মধ্যে কোনাে বিরােধ নেই। স্বদেশপ্রেমের মধ্যে বিশ্ব ঐক্যের মন্ত্র প্রােথিত আছে বলেই রবীন্দ্রনাথ, শেক্সপিয়র, নিউটন, নজরুল দেশ-কালের গণ্ডি অতিক্রম করে বিশ্বের সকল মানুষের হয়েছেন। দেশমাতা আর বিশ্বমাতা যে একই সম্পর্কে বাধা তা আমরা কবিগুরুর বাণীতেই খুঁজে পাই – ও আমার দেশের মাটি, তােমার পরে ঠেকাই মাথা তােমাতে বিশ্বময়ীর–– তােমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা।

উপসংহার:

স্বদেশপ্রেম মানুষের অন্যতম মহৎ গুণ। মানুষকে সকল প্রকার ক্ষুদ্রতা, সংকীর্ণতা, স্বার্থপরতা থেকে মুক্ত করে বৃহৎ ও মহত্বের সন্ধান দেয় স্বদেশপ্রেম । তা মানুষের মানবিক মূল্যবােধের বিকাশ ঘটায়। প্রয়ােজনে দেশ ও জাতির কল্যাণে জীবন বিসর্জন দিতে শেখায়। তাই দেশ ও জাতিকে সমৃদ্ধ করতে হলে, বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে স্বদেশপ্রেমের চেতনা অপরিহার্য। দেশগঠনের জন্যে সে মানবতাবাদী দেশপ্রেমিক প্রয়ােজন যিনি এডউইন আর্নল্ডের মতাে মুক্তকণ্ঠে ঘােষণা- জীবনকে ভালােবাসি সত্য, কিন্তু দেশের চেয়ে বেশি না।

নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ

নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবােধ রচনার সংকেত (Hints)

  • ভূমিকা
  • নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবােধের স্বরূপ
  • সমাজজীবনে নৈতিক মূল্যবােধের গুরুত্ব
  • অনৈতিক মূল্যবােধের অবক্ষয়ের কারণ
  • মূল্যবোেধর অবক্ষয়ের ফল
  • অবক্ষয় রােধে পদক্ষেপ
  • উপসংহার

ভূমিকা:

‘নৈতিক’ কথাটি নীতির সাথে সম্পর্কযুক্ত। সকল ক্ষেত্রে সুনীতিই নৈতিক মূল্যবােধের নিয়ামক। ব্যক্তিজীবনে এবং সামাজিক জীবনে কোনাে মানুষ কোনাে কালেই সকলের শ্রদ্ধা ও বিশ্বস্ততা লাভ করতে পারে না যদি তার না থাকে নৈতিক মূল্যবােধ। নৈতিক মূল্যবােধের বিষয়টি শুভবােধ, সৎ চিন্তা, সততা, নির্লোভ জীবন পদ্ধতির সাথেও সম্পৃক্ত।

নৈতিক সামাজিক মূল্যবোধের স্বরূপ:

যে ব্যক্তি ব্যক্তিজীবনে সত্য কথা বলাকে অভ্যাসে পরিণত করতে পারেনি তার মধ্যে নৈতিক মূল্যবোেধ আশা করা অসংগত। পরােপকার করতে যার মন কাঁপে, লােভের বশবর্তী হয়ে যে অন্যের অধিকার হরণ করে তার মধ্যে সুনীতি আশা করা যায় না। সামাজিক জীবনে পরহিত কামনা করা, কল্যাণের পক্ষে অবস্থান নেওয়া, সৎচিন্তা চর্চা করা, মিথ্যাকে পরিহার করে সত্য সুন্দর ন্যায়সংগত জীবনের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার মধ্যে নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবােধের উজ্জ্বল উপস্থিতি লক্ষ করা যায় নৈতিক মূল্যবােধ তাই মানুষের শ্রেষ্ঠ অলংকার।

সমাজজীবনে নৈতিক মূল্যবোধের গুরুত্ব:

সমাজের প্রধান উপকরণ মানুষ। মানুষই সমাজকে উঁচুতে আসীন করে আবার মানুষের অনৈতিক কর্মকাণ্ডই কোনাে সমাজকে ভরাডুবি করে। নৈতিক মূল্যবােধসম্পন্ন মানুষ স্বভাবতই উত্তম চরিত্রের হয়ে থাকে। তাই সৎ, চরিত্রবান মানুষের প্রভাব পড়ে সমাজে। ফলে কোনাে সমাজ হয়ে ওঠে উঁচু আদর্শের সমাজ। সমাজে দরকার আলােকিত মানুষ যারা নিজেরা আলােকিত এবং সমাজকেও আলােকিত করে। আর নৈতিক মূল্যবােধ যার প্রখর নয় সে তাে আলােকিত মানুষ নয়। তাই সুন্দরের প্রয়ােজনে নৈতিক মূল্যবােধের প্রয়ােজনীয়তা অসীম। যে মাজে নৈতিক মূল্যবােধসম্পন্ন মানুষ যত বেশি সে সমাজ তত সুখী ও সমৃদ্ধ। সমাজে নৈতিক জ্ঞানসম্পন্ন মানুষের অভাব হলে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা অসম্ভব আর ন্যায়বিচার যেখানে অনুপস্থিত সেখানে শান্তি নির্বাসিত। তাই সমাজজীবনে নৈতিক মূল্যবােধের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

অনৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণ:

কোনাে একটি বিশেষ কারণে মানুষের নৈতিক মূল্যবােধের পতন ঘটে না। নানাবিধ কারণে এ অবক্ষয়ের শিকার হয় মানুষ । সমাজজীবনে চরম দারিদ্র্য, শিক্ষিত বেকারের কর্মহীনতা, ভােগবাদী মানুষের বিলাসী প্রতিযােগিতা, আপাত স্বার্থের লােভে পতিত হওয়া, জাতীয় জীবনে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা না থাকা, ধর্মীয় বিধিনিষেধকে গুরুত্ব না দেওয়া ইত্যাদি কারণেই মানুষ তার নৈতিক মূল্যবােধ হারায়। মানুষ যখন নৈতিক মূল্যবােধ হারায় তখন প্রকৃতপক্ষে তার উৎকৃষ্ট চরিত্রকেই হারায় । আর মানুষের চরিত্রই যখন থাকে না তখন আর অন্য কিছু থাকলেও বা কি!

মূল্যবোেধর অবক্ষয়ের ফল:

নৈতিক মূল্যবােধের অবক্ষয়ের ফলাফল হচ্ছে অসুন্দর সমাজ। সমাজজীবনে অন্যায়, দুর্নীতি আর অনিয়ম নৈতিক মূল্যবােধের অবক্ষয়েরই ফল। মূল্যবোেধ ভেঙে পড়লে সমাজে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে পেশিশক্তির প্রয়ােগে ক্ষমতাবানরা ক্ষমতাহীনের ওপর উৎপীড়ন চালায় সহজেই। মানসভ্যতা যখন চরম উন্নতির পথে ধাবমান তখন পরিতাপের হলেও স্বীকার্য আমাদের দেশে মূল্যবােধের চরম অবক্ষয় ঘটেছে। ফলে দুর্নীতিতে সর্বোচ্চ শিখরে আসীন আমাদের দেশ। বিশ্বজনের কাছে এ সংবাদ– জাতি হিসেবে আমাদেরকে গৌরবান্বিত করে না বরং আমাদের আত্মমর্যাদাবােধ আজ কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন। মূল্যবােধের অবক্ষয়ের ফলেই সমাজে দুবৃত্তের দল অন্যায় সংঘটনে সাহস পায়। চাঁদাবাজি, রাহাজানি ওঅরুচিপূর্ণ বিনােদনে মানুষ মত্ত থাকে তখনি যখন মানুষের মূল্যবােধ থাকে না। একটি সমাজে বা জাতির জীবনে মূল্যবােধের এমন অবক্ষয় কাটিয়ে উঠতে না পারলে তারা নিক্ষিপ্ত হবে আস্তাকুঁড়ে। সভ্য জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে নৈতিক মূল্যবােধের এ পতনকে রুখে দিতে হবে ।

অবক্ষয় রােধে পদক্ষেপ:

নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবােধের এ অবক্ষয় রােধ করার দায়িত্বটি প্রথমে ব্যক্তি নিজে এবং পরিবার থেকে শুরু করতে হবে। নিজে ব্যক্তিগতভাবে সুনীতি ও শুভবােধের চর্চার মধ্য দিয়ে পরিবার ও সমাজকে উৎসাহিত করতে হবে। পাশাপাশি রাষ্ট্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং নীতিবােধসম্পন্ন দক্ষ জনপ্রশাসন গড়ে তুলতে হবে। নৈতিক মূল্যবােধের পরিপন্থি বিনােদনমূলক অনুষ্ঠান প্রচারের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ আরােপ করতে হবে। দেশের জনগণকে উচ্চ মূল্যবােধসম্পন্ন সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তােলার জন্যে সমাজে মূল্যবােধে জাগ্রত নিবেদিত প্রাণ উপযুক্ত ব্যক্তিকে পুরস্কারের মধ্য দিয়ে অন্যদেরকে উৎসাহিত করা যেতে পারে।

উপসংহার:

একটি সুন্দর কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং আদর্শ সমাজ বিনির্মাণের তাগিদ থেকে আমাদের নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবােধের জাগরণ জরুরি। সত্য, সততা ও ন্যায়কে আমরা হ্যা বলব । জীবনে সকল পর্যায়ে সুনীতি, সুবচন ও শুভ বােধ হােক আমাদের চর্চার বিষয়। তবেই আমরা উন্নীত হব সম্মানজনক সামাজিক জীবনে।।

মাতাপিতার প্রতি কর্তব্য রচনা

ভূমিকা

বিভিন্ন ধর্মে মাতাপিতার অবস্থান

মাতাপিতার ভূমিকা

মাতাপিতার প্রতি করণীয়

মাতাপিতার সন্তুষ্টিতে করণীয়

মাতাপিতার বার্ধক্যে করণীয়

উপসংহার

ভূমিকা:

প্রত্যেক মানুষেরই জীন ও অস্তিত্ব মাতাপিতার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। এ পৃথিবীতে কোনােভাবেই কোনাে সন্তান বাবা-মায়ের ঋণ শােধ করতে পারে না। সন্তানের কাছে মাতাপিতার আসন সবার ওপরে। জন্মের পর থেকে সন্তান লালিত পালিত হয় মাতাপিতার সাহচর্যে, নিবিড় স্নেহচ্ছায়ায়। সন্তানের আচরণ, শিক্ষা- এককথায় জীবন গড়ে ওঠে মাতাপিতার প্রভাবে । তাই সকল সন্তানের উচিত তাদের অপার স্নেহের প্রতিদান দেওয়া।

বিভিন্ন ধর্মে মাতাপিতার অবস্থান:

প্রত্যেক ধর্মেই মাতাপিতাকে সম্মানজনক স্থান দিয়ে তাদের সামাজিক মর্যাদার আসনটিকে গৌরবান্বিত করা হয়েছে। ইসলাম ধর্মে মাতার পদতলে সন্তানের বেহেশত’ ঘােষিত হয়েছে। পাশাপাশি বলা হয়েছে মাতাপিতার সন্তুষ্টি ব্যতীত সন্তানের জান্নাতপ্রাপ্তি অনিশ্চিত। হিন্দু বর্ণিত আছে’ ‘জননী স্বর্ণ অপেক্ষা গরীয়সী। পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম; পিতাই পরম তপস্যার ব্যক্তি। পিতাকে সন্তুষ্ট করলে সকল দেবতা সন্তুষ্ট হন। খ্রিষ্টধর্মেও এরূপ কথা বলা হয়েছে। সর্বোপরি ধর্ম মাতাপিতাকে তাদের যােগ্য অবস্থানের স্বীকৃতি দিয়েছে। কোনাে ধর্মই মাতাপিতার উচ্চ আসনকে খর্ব করেনি।

মাতাপিতার ভূমিকা:

পৃথিবীর আলােতে সন্তানের দিনযাপন শুরু হবার আগেই মাতৃগর্ভে সন্তানের জন্ম ও বৃদ্ধি ঘটতে থাকে। বেঁচে থাকার জন্যে অনিবার্য খাদ্যটুকুও মায়ের সহযােগিতা ছাড়া গ্রহণ করতে পারে না। মাতাপিতার যুগল প্রচেষ্টা এবং সেবায় বড় হতে থাকে শিশু। সন্তানের পড়াশুনা নিশ্চিত করা, ভরণপােষণ, স্বাস্থ্যের প্রতি মনােযােগ ইত্যাদি বিষয়ে যত্নশীল। তত্ত্বাবধানের পর যতক্ষণ না সন্তান স্বাবলম্বী বা আত্মনির্ভরশীল হবে; সে পর্যন্ত মাতাপিতার কোনাে স্বস্তি নেই। মােটকথা। জীবনের সুদীর্ঘ সময় সন্তানের প্রতি মাতাপিতা থাকেন নির্ভরশীল সহায়ক শক্তি, যে শক্তির ওপর সন্তান রচনা করে তার অনাগত দিনের ভিত্তি। তাই স্তানের প্রতি মাতাপিতার এ অবদানকে বড় করে দেখাই স্বাভাবিক।

মাতাপিতার প্রতি করণীয়:

মাতাপিতা পরম স্নেহে সন্তানকে লালন করলেও সন্তানের প্রতি এমন কোনাে দাবি প্রকাশ করে না। প্রতিদান হিসেবে সন্তানের নিকট মাতাপিতা মােটা অঙ্কের অর্থ কিংবা অন্য কোনাে বিনিময় প্রত্যাশা করেন না। তবুও মাতাপিতার প্রতি সন্তানের রয়েছে অনেক করণীয়। মাতাপিতাকে সম্পূর্ণ আন্তরিক শ্রদ্ধার সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। তাদের অসুস্থতায় সর্বাগ্রে সন্তানকে এগিয়ে আসতে হবে, তাদের উপযুক্ত সেবা নিশ্চিত করতে হবে । মাতাপিতা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতার কথা সন্তানকে বুঝতে দিতে চান না, সে ক্ষেত্রে সন্তানের উচিত নিজে উদ্যোগী হয়ে মাতাপিতার প্রতি উদার ব্যবহার করা । পিতা যদি উপার্জনে অক্ষমও হন সন্তানের উচিত নয় পিতাকে সহযােগিতা না করা এমনকি মাতাপিতার ভুল কাজেও সন্তানের কঠোর আচরণ করা সংগত নয় । মাতাপিতার সাথে পরম আত্মীয়সুলভ আন্তরিক আচার ব্যবহার করতে হবে যাতে পারিবারিক জীবন হয়ে ওঠে আনন্দমুখর।

মাতাপিতার সন্তুষ্টিতে করণীয়:

যুগে যুগে যে সকল মহামানবদেরকে জগতের শ্রেষ্ঠ মানব হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়ে থাকে তাদের জীবন আলােচনা করলে দেখা যায়, তারা ছিলেন মাতাপিতার প্রতি অসীম শ্রদ্ধাশীল । তারা মনে করতেন মাকে অশ্রদ্ধা করলে মাটি অপবিত্র হয় এবং পিতাকে অন্তুষ্ট করলে সৃষ্টিকে অস্বীকার করা হয়। মাতার সন্তুষ্টির জন্যে বালক বায়েজিদ বােস্তামি নিদ্রাহীন রাত পার করেছিলেন। মা খুশি হয়ে স্রষ্টার কাছে আশীর্বাদ কামনা করলেন। পরবর্তীতে বায়েজিদ আল্লাহর প্রিয় মানুষে পরিণত হলেন। মায়ের সন্তুষ্টি বালক বায়েজিদের জীবনে যে উন্নতি বয়ে এনেছিল তা ছিল পৃথিবীবাসীর জন্যে একটি বড় উদাহরণ । পক্ষান্তরে, মাতাপিতার অসন্তুষ্টি সন্তানের জন্যে অমঙ্গলেরও কারণ। ধর্মে আছে মাতাপিতা যদি সন্তানের প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন তাহলে স্রষ্টা নিজেও তাঁর বান্দার প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন তাই সকলের উচিত মাতাপিতার প্রতি যত্নবান হওয়া যাতে তারা সন্তুষ্ট থাকেন।

মাতাপিতার বার্ধক্যে করণীয়:

প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে সকল মানুষকেই বর্ধক্যে উপনীত হতে হয় বার্ধক্যকে ব্যাধিও বলা হয়ে থাকে বার্ধক্য মানুষের স্বাভাবিক কর্মতৎপরতাকে থামিয়ে দেয়। এক সময়ের বলবান মানুষটিই বার্ধক্যের সিঁড়িতে এসে বলহীন হয়ে পড়ে। শারীরিক সামর্থ্য হারিয়ে উপার্জন করা তার পক্ষে আর সম্ভব হয় না। ফলে অনেক সন্তানকেই দেখা যায় মাতাপিতাকে পরিবারের জন্যে বােঝা মনে করে এবং তাদেরকে রেখে আসে বৃদ্ধাশ্রমে । সন্তান উপার্জনক্ষম অথচ তার বৃদ্ধ মাতাপিতা বৃদ্ধাশ্রমে এ অবস্থা কোনাে সন্তান বা পরিবারের জন্যে আনন্দদায়ক সংবাদ নয়। বৃদ্ধ মাতাপিতাকে সন্তানের সাধ্যমতাে সেবা করা উচিত । মাতাপিতার সুচিকিৎসা এবং প্রয়ােজনীয় সেবাদান সন্তানের নৈতিক দায়িত্ব।

উপসংহার:

মাতাপিতা সন্তানের জন্যে শ্রেষ্ঠ আশীর্বাদ। মাতাপিতার সতর্ক পৃষ্ঠপােষকতার ফলেই সন্তান উচ্চতর জীবনের সন্ধান লাভ করে। মাতাপিতা ও সন্তানের বন্ধন পৃথিবীতে পরম ভালােবাসার বন্ধন। মাতাপিতার প্রতি উপযুক্ত কর্তব্য পালনের মধ্য দিয়ে সে বন্ধন আরও সুদৃঢ় হতে পারে।

ছাত্রজীবনের দায়িত্ব কর্তব্য

  • ভূমিকা
  • ছাত্রজীবনের স্বরূপ
  • দায়িত্ব ও কর্তব্য
  • ছাত্রজীবনের মূল উদ্দেশ্য
  • দেশের কর্ণধার হিসেবে দায়িত্ব
  • সমাজ সচেতনতা
  • পিতামাতা ও গুরুজনদের প্রতি কর্তব্য
  • রাজনৈতিক দায়িত্ব
  • উপসংহার

ভূমিকা:

মানুষ জ্ঞান আহরণের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠানে গিয়ে জীবনের যে মূল্যবান সময় ব্যয় করে থাকে এককথায় তাকে বলে ছাত্রজীবন । ছাত্রজীবন জীবনের প্রস্তুতি গ্রহণের সময়। এ সময়টিকে জীবনের উজ্জ্বলতম সময় হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। ছাত্রজীবনই একটি সফল জীবনের বীজ বপনের সময় বলে এ সময়টির রয়েছে বিশেষ তাৎপর্য।

ছাত্রজীবনের স্বরূপ:

ছাত্রজীবনে জ্ঞান ও বিদ্যা অর্জনের জন্যে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। পরীক্ষা নামক সুকঠিন প্রাচীর পেরিয়ে একজন ছাত্র লাভ করে বিজয়ের আনন্দ। ছাত্রজীবনে মেনে চলতে হয় শৃঙ্খলা, গ্রহণ করতে হয় অধ্যবসায়ের মূলমন্ত্র । কঠোর অধ্যবসায়ী হতে পারার মধ্যেই ছাত্রজীবনের প্রধান লক্ষণ প্রকাশ পায়। অলস-উদ্যমহীন জীবন ছাত্রজীবনের প্রকৃত পরিচয়কে তুলে ধরতে পারে না। ছাত্রজীবনে নানা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন শ্রেণির বােম্বা গবেষক ও খ্যাতিমান শিক্ষকদের সান্নিধ্য লাভ করে ছাত্রছাত্রীরা। ফলে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমের বাইরেও শিক্ষার্থী লাভ করে জ্ঞান অর্জনের সুযােগ । ছাত্রজীবনে অর্জিত জ্ঞান ও বুদ্ধি-বিবেচনা পরবর্তী জীবনে ব্যাপকভাবে প্রয়ােগ হয় বলে ছাত্রজীবনই জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় হিসেবে বিবেচিত।

দায়িত্ব কর্তব্য:

ছত্রাণং অধ্যয়নং তপঃ- অধ্যয়নই ছাত্রজীবনের পরম কর্তব্য। ছাত্রজীবনের সর্বপ্রথম এবং সর্বপ্রধান দায়িত্ব হচ্ছে অধ্যয়ন করা। কারণ পরিশ্রম ও অধ্যবসায় ব্যতীত কোনাে ছাত্র তার জীবনকে আলােকিত করতে পারে না। পৃথিবীর বুকে যারা বিজ্ঞান, শিল্পকলা, সাহিত্য ও অন্যান্য বিষয়ে খ্যাতির স্বর্ণতােরণে আসীন হয়েছেন তাঁদের জীবন পর্যালােচনা করলে দেখা যায়, তারা ছাত্রজীবনে ছিলেন কঠোর অধ্যবসায়ী। অর্থাৎ তাদের ছাত্রজীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্য নিয়ে তাঁরা ছিলেন সদা সচেতন। ছাত্রজীবনের মূল দায়িত্ব অধ্যয়ন হলেও সময়ানুবর্তিতা, শৃঙ্খলাবােধ, আদব-কায়দা ইত্যাদি মানবিক গুণগুলাে এ সময়েই চর্চা করতে হয়। ছাত্রজীবনের সমস্ত সঞ্চয়ই ব্যক্তি জীবনের পরবর্তী সকল পদক্ষেপে কাজে লাগে। তাই সৎ চরিত্রবান হতে হলে সততার চর্চা করা, সত্যবাদী হওয়া, নিজ কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হওয়া ইত্যাদি সৎ গুণগুলাে ছাত্রজীবনে অনুশীলন করা ছাত্রদের কর্তব্য। স্বাস্থ্যই সুখের মূল। তাই ছাত্রজীবনে স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নবান হওয়াও ছাত্রছাত্রীদের কর্তব্য। কেননা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী না হলে তার পক্ষে অধ্যয়ন অনুশীলন কোনােটাই সম্ভব নয়।

ছাত্রজীবনের মূল উদ্দেশ্য:

ছাত্রজীবনের মূল কাজ অধ্যয়ন হলেও মূল উদ্দেশ্য তা নয়। প্রত্যেকটি মানুষের কাজই একটি লক্ষ্য নিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হওয়া। তেমনি ছাত্রজীবনেরও একটি লক্ষ্য থাকা প্রয়ােজন। শুধু পরীক্ষার পর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে একগাদা সনদ অর্জন ছাত্রজীবনের উদ্দেশ্য হতে পারে না। ছাত্রজীবনের প্রধান লক্ষ্য হবে জ্ঞানার্জন। জ্ঞানার্জন না হলে মানুষ মুক্তচিন্তার অধিকারী হতে পারে না ফলে সংকীর্ণ ও অনুদার দৃষ্টিভঙ্গি হয় তাদের। যা কিনা কোনাে সুশিক্ষিত মানুষের ভূষণ হতে পারে না। তাই ছাত্রজীবনের উদ্দেশ্য হবে নিজেকে জ্ঞানে গুণে বিকশিত করে একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে গড়ে তােলা।

দেশের কর্ণধার হিসেবে দায়িত্ব:

আজকের ছাত্রছাত্রীরা আগামী দিনে জাতির নেতৃত্ব দান করবে। এ নেতৃত্ব দান নিছক দায়িত্ব মাত্র নয়। এ গুরুদায়িত্ব পালনে সক্ষম হতে হলে আজকের ছাত্রকে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে যথাযথ যােগ্যতা অর্জন করতে হবে। তাদের নৈতিক চরিত্র হতে হবে সর্বজন। ছাত্রদের কাছে জাতির প্রত্যাশা অনেক। জাতিকে সঠিক এবং উন্নয়নের পথে পরিচালনা করার জন্যে তাদের হাতেই একদিন দায়িত্ব বর্তাবে। তাই ছাত্রদের দেশের কর্ণধার হিসেবে নিজকে প্রস্তুত করতে হবে।

সমাজ সচেতনতা:

একজন ছাত্রকে সমাজ সচেতন হতে হবে । ছাত্র যদি তার দেশ, কাল, সমাজ সম্পর্কে সচেতন না হয় তাহলে তার দ্বারা সমাজের হিত কাজ অসম্ভব । সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে কোনাে অন্যায়, অনাচার দুর্নীতি যদি প্রকট আকার ধারণ করে তখন ছাত্রদের বসে থাকলে চলবে না। এর প্রতিকার প্রতিরােধের জন্যে সােচ্চার প্রতিবাদ করাও ছাত্রদের দায়িত্ব। ছাত্রসমাজের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় সমাজ-সংসারের কুসংস্কার দূরীভূত হয়ে, অন্যায়-অবিচার তিরােহিত হয়ে একটি সুন্দর সমাজ বিনির্মাণ হতে পারে। তাই ছাত্রজীবনে হতে হবে দেশ, কাল ও সমাজসচেতন, সমাজহিতৈষী।

পিতামাতা গুরুজনদের প্রতি কর্তব্য:

পিতামাতা ও গুরুজনদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা ছাত্রদের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের মনােভাব তাদের নৈতিক দিক থেকে আদর্শবান করে তােলে। গুরুজনের আদেশ-নিষেধ মেনে না। চললে জীবনে উন্নতি অসম্ভব। তাই তাদের দিক নির্দেশনা যথাযথ পালনে ছাত্রদের ব্রতী হতে হবে। পিতামাতা ও গুরুজনদের প্রতি সম্মান ও কর্তব্য সম্পাদনের মধ্য দিয়ে ছাত্ররা শিষ্টাচার চর্চার সুযােগও লাভ করে।

রাজনৈতিক দায়িত্ব:

ছাত্ররা একটি দেশের জাগ্রত অংশ। তাদের কখনাে কখনাে রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করতে হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ছাত্রদের দেখা গিয়েছে অগ্রণী ভূমিকায়। আমাদের বাংলাদেশের বেলায়ও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। অধিকার আদায়েও ছাত্রদের থাকে একটি বড় ভূমিকা। আমাদের মাতৃভাষা হবে আমাদের রাষ্ট্রভাষা— এ অধিকার আদায়ে রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানে একদিন কেঁপে উঠেছিল দেশ। ছাত্ররা অধিকার আদায়ে প্রাণ দিয়েছিল । এটি পৃথিবীর একটি উল্লেখযােগ্য ঘটনা। তাই ছাত্রদের রাজনীতি সচেতন হতে হবে, প্রয়ােজনে যেন তারা রাজনৈতিক কর্তব্য পালন করতে পারে।

উপসংহার:

আজ যারা বিদ্যালয়গামী শিশু, কিশাের, তরুণ, তারাই আগামী দিনের দেশের পরিচালক। দেশ ও জাতি তাদের কাছে প্রত্যাশা করে অনেক কিছু। তাই ছাত্রজীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে ছাত্রদেরই হতে হবে অগ্রণী, তাদের হাতেই দেশের ভবিষ্যৎ।

জাতি গঠনে ছাত্র সমাজের ভূমিকা রচনা

  • ভূমিকা
  • ছাত্রদের ভূমিকার কারণ
  • ছাত্রদের ভূমিকার স্বরূপ
  • ছাত্রসমাজ ও জাতীয় কর্তব্য
  • ছাত্রসমাজ ও সমাজসেবা
  • ছাত্রসমাজ ও দেশপ্রেম
  • নিরক্ষরতা দূরীকরণ
  • গণশিক্ষা বিস্তার
  • গ্রামোন্নয়ন
  • দুর্নীতি দমনে সহযােগিতা
  • বেকারত্ব নিরসন
  • পরিবেশ সংরক্ষণ
  • সাংস্কৃতিক অবদান
  • উপসংহার

ভূমিকা:

ছাত্ররা যেকোনাে দেশের সবচেয়ে সচেতন ও প্রগতিশীল অংশ। দেশকে অর্থাৎ জাতিকে সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের পথে ধাবিত করতে ছাত্রসমাজের ভূমিকা অনস্বীকার্য। একজন প্রকৃত ছাত্রের সাধনা হলাে বিনয়ী, সৎ, দেশব্রতী, মুক্তমনা, আত্মত্যাগী ও আত্মবিশ্বাসী মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তােলার সাধনা । তাই চিন্তাচেতনা ও শিক্ষায় অগ্রগামী এ ছাত্ররাই দেশ ও জাতির সেরা সম্পদ। আজকের ছাত্ররাই জাতির আগামী দিনের পথপ্রদর্শক। উন্নয়নশীল দেশগুলাের আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক অগ্রগতি নিশ্চিত করতে প্রয়ােজন উপযুক্ত দেশব্রতী নেতৃত্ব। আর ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের এ প্রয়ােজন মেটাতে হবে আজকের প্রজন্মকে। জাতির গৌরব বৃদ্ধির সুমহান দায়িত্ব একদিন আজকের ছাত্রদের গ্রহণ করতে হবে। তাদের কৃতকর্মের সফলতার ওপরই জাতির ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধি নির্ভরশীল।

ছাত্রদের ভূমিকার কারণ:

ছাত্ররা তারুণ্যের উদ্দীপনায় উদ্দীপ্ত । নতুন কিছু করার ও গড়ার স্বপ্নে তারা সবসময় বিভাের। তারা উদ্যমী ও দায়িত্ব পালনে উদ্যোগী। যেকোনাে বাস্তব পরিস্থিতি মােকাবিলায় প্রয়ােজনে ছাত্ররাই পারে অকুতােভয় সংগ্রামী ভূমিকা পালন করতে আমাদের ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধসহ নানা আন্দোলন-সংগ্রামই তার উল্লেখযােগ্য উদাহরণ এছাড়াও ছাত্ররা স্বাধীন উদ্যোগ ও স্বেচ্ছাব্রতী দেশ গঠনমূলক কাজে যথেষ্ট উৎসাহ পায়। তাই জাতি গঠনে ছাত্ররাই পালন করতে পারে গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ভূমিকা। সর্বোপরি একাধারে সংগঠক ও শিক্ষাদাতা কর্মীর ভূমিকা পালন করা তাদের পক্ষেই বিশেষভাবে সম্ভব।

ছাত্রদের ভূমিকার স্বরূপ:

একটি দেশ গঠনে একমাত্র ছাত্ররাই রাখতে পারে যুগােপযােগী ভূমিকা । কেননা যেকোনাে দেশের আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার আলােকেই ছাত্ররা তাদের দেশ গঠনের কার্যক্রম নির্ধারণ করে। জাতি গঠনে ছাত্রদের ভূমিকা দু দিক থেকে বিবেচ্য। প্রথমত, ছাত্ররা নিজের জীবন গঠনে তৎপরতা দেখিয়ে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের জন্যে যােগ্যতা অর্জন করে। দ্বিতীয়ত, তারা প্রত্যক্ষভাবে জাতি গঠনের বিভিন্ন প্রক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত হতে পারে। শিক্ষা লাভের জন্যে ছাত্রসমাজ সংঘবদ্ধ থাকার সুযােগ পায় বলে তারা সংঘবদ্ধ এবং প্রবল শক্তি হিসেবে দেশ গঠনমূলক কাজে সম্পৃক্ত হয়।

ছাত্রসমাজ জাতীয় কর্তব্য:

যুগে যুগে ছাত্ররাই রচনা করে স্বপ্নিল পৃথিবী। নিদ্রাচ্ছন্ন পথভ্রষ্ট জাতিকে তারাই দেখায় আলােকবর্তিকা । তাদের শক্তি অপরিমেয়, গতিবেগ দুর্বার, উৎসাহ ক্লান্তিহীন এবং সাধনা তাদের অটল । দেশ ও জাতির কল্যাণে তারা অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তারা মুক্তির অগ্রদূত, মুক্তপ্রাণ ও মুক্তদৃষ্টির অধিকারী । সমাজপ্রগতি ও নতুন স্বপ্নময় জীবনের পথে তাদের দৃঢ় পদ্যাত্রা। তারাই জাতির কর্ণধার। নিজেকে মানুষ হিসেবে গড়ে তােলার সাথে সাথে দেশের বিরাজমান পরিস্থিতি মােকাবিলা করে ছাত্রদের জাতীয় উন্নয়নমূলক বিভিন্ন কাজে অংশগ্রহণ করা উচিত। যেমন: দুর্গত ও বিপন্ন মানবতার সেবা, জনসেবা, গ্রামােন্নয়ন, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, গরিব ও মেহনতি মানুষকে সহায়তা, জনস্বাস্থ্য রক্ষা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম, পরিবেশ সংরক্ষণ, বৃক্ষরােপণ ইত্যাদি। এসব দেশ গঠনমূলক কাজের মাধ্যমেই তারা ভবিষ্যতে জাতীয় জীবনে সুশীল নাগরিকের দায়িত্ব পালন করার শিক্ষা লাভ করবে।

ছাত্রসমাজ সমাজসেবা:

বিদ্যার্জনের পাশাপাশি সমাজসেবামূলক দায়িত্ব পালন এবং দুর্যোগ-দুর্বিপাকে বিপন্ন মানুষের পাশে দাড়ানাে ছাত্রদের কর্তব্য। ছাত্রদের সামাজিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে বন্যা, জলােচ্ছাস, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপন্ন জনগণের পাশে দাড়ানাে। বিভিন্ন জনসচেতনতামূলক কাজের মাধ্যমে তারা সমাজের উপকার সাধন করতে পারে। যেমন: বায়ুদূষণ, পানিদূষণের বিরুদ্ধে সক্রিয় নানা ভূমিকা, পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখায় সহযােগিতা, আর্সেনিক দূষণ। কিংবা ডেঙ্গুর প্রকোপের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টি, নিরক্ষরতা দূরীকরণ পরিকল্পনায় অংশগ্রহণ ইত্যাদি সেবামূলক কাজ। সমাজের প্রতি ছাত্রদের আজকের সেবাপরায়ণ মনােভাবই তাদের ভবিষ্যতের যােগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলবে।

ছাত্রসমাজ দেশপ্রেমঃ

দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিক ও পরিচালক ছাত্রসমাজ। তাই ছাত্রদের দেশপ্রেমের আদর্শে উজ্জীবিত হতে হবে। কেননা ছাত্রদের মনে উপ্ত দেশপ্রেমের ক্ষুদ্র বীজই ভবিষ্যতে কর্মময় জীবনের বিশাল আকার ধারণ করবে। ছাত্ররাই পারে দেশের বিপদে কর্তব্যের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সকল প্রকার ত্যাগ স্বীকার করতে। ইতিহাসের পাতায় দেখা যায় ঔপনিবেশিক দেশ ও উন্নয়নশীল দেশগুলােতে সমাজের সচেতন ও সংগ্রামী অংশ হিসেবে ছাত্রসমাজই রাজনৈতিক সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। আমাদের দেশেও ছাত্ররা ভাষা আন্দোলনে, শিক্ষা আন্দোলনে, ৬ দফা ও ১১ দফার আন্দোলনে এবং রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে গৌরবােজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছে। ছাত্রদের আত্মত্যাগই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের অন্যতম হাতিয়ার। সুতরাং, ছাত্রসমাজই পারে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে দেশের সার্বিক কল্যাণের বাণী স্বস্তরের জনগণের কাছে পৌছে দিতে।

নিরক্ষরতা দূরীকরণ:

নিরক্ষরতা বাংলাদেশের অগ্রগতির পথে অন্যতম প্রধান সমস্যা। ছাত্ররা প্রাণদীপ্ত তারুণ্যের অধিকারী। নতুন কিছু করার এবং গড়ার কাজে তারা উদ্যোগী এবং উৎসাহী। তাই নিরক্ষরতা দূরীকরণে ছাত্ররাই সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে । একাধারে সংগঠক এবং শিক্ষাদাতা কর্মীর ভূমিকা পালন করা তাদের পক্ষেই বিশেষভাবে সম্ভব।

গণশিক্ষা বিস্তার:

দারিদ্র্যপীড়িত আমাদের এদেশে বিপুল জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করতে হলে চাই সবার জন্যে শিক্ষা তথা গণশিক্ষা। গণশিক্ষা বিস্তারে ছাত্রদের অংশগ্রহণই গণশিক্ষা আন্দোলনকে দুত সাফল্যমণ্ডিত করতে পারে। বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে নিরক্ষরতার অভিশাপ সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার ক্ষেত্রে সারাদেশ ছাত্রসমাজই বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে। তাই দেশকে নিরক্ষরতামুক্ত করতে হলে ছাত্রদের অবকাশকালীন গণশিক্ষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ খুবই প্রয়ােজন ।

জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ:

অধিক জনসংখ্যা বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা। দেশের নিরক্ষর জনসাধারণ জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে অসচেতন। ছাত্ররাই পারে এক্ষেত্রে জনগণকে সচেতন করে তুলতে । দেশের শিক্ষিত সমাজ হিসেবে সাধারণ মানুষ ছাত্রদের প্রতি শ্রদ্ধা পােষণ করে। তাই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে ছাত্রদের বিভিন্ন পরামর্শ ও জ্ঞানদান তারা গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করবে।

গ্রামােন্নয়ন:

আমাদের দেশ গ্রামপ্রধান দেশ। তাই এদেশের উন্নয়ন মূলত গ্রামেরই উন্নয়ন। কেননা আমাদের দেশের অধিকাংশ লােকই গ্রামে বাস করে। তাই দেশের বিপুল অংশকে বাদ দিয়ে দেশ উন্নত হতে পারে না। কিন্তু গ্রাম আজ অবহেলিত। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা সবকিছু থেকে বঞিত। দেশের উল্লেখযােগ্য অংশ ছাত্রসমাজই পারে গ্রামের এ দুর্দশার অবসান ঘটাতে । তাদের কর্মোদ্যম ও কর্মোদ্যোগ গ্রামের ঘরে ঘরে শিক্ষার আলাে পৌছে দিতে পারে এবং গ্রামের মানুষকে সচেতন করে তুলতে পারে।

দুর্নীতি দমনে সহযােগিতা:

ছাত্ররা যাবতীয় সংকীর্ণ চেতনার উর্ধ্বে। চারিত্রিক দৃঢ়তাই তাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। সমাজ ও দেশে যেখানেই নৈতিকতার অবক্ষয় দেখা দেয় সেখানেই শােনা যায় তাদের সােচ্চার কণ্ঠের প্রতিবাদ। যেখানে দুর্নীতির কালাে হাত থাবা দিয়েছে সেখানে দেখা যায় ছাত্রদের বলিষ্ঠ অবস্থান, ছাত্রদের এ ভূমিকাই জন্ম দিতে পারে একটি দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ।

বেকারত্ব নিরসন:

বেকার সমস্যা আমাদের দেশের অন্যতম সমস্যা, বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথেই ঘটে নৈতিক স্থলন। বৃদ্ধি পায় সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি প্রভৃতি অপকর্ম। ছাত্ররা নতুন প্রাণ, নতুন চিন্তার অধিকারী, নবসৃষ্টির তাড়না তাদের প্রাণে। ছাত্ররা যদি তাদের চিন্তাচেতনা দিয়ে নিজেরাই নিজেদের কর্মসংস্থানের পন্থা উদ্ভাবন করতে পারে, তাহলে দেশ বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে।

পরিবেশ সংরক্ষণ:

কেবল আমাদের দেশে নয়, পুরাে বিশ্বে পরিবেশ আজ হুমকির সম্মুখীন। জনগণের অসচেতনতা এবং স্বার্থপরতা পরিবেশকে দূষিত করছে প্রতিনিয়ত। লাগামহীন জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়ন, বনভূমির অপরিকল্পিত ব্যবহার পরিবেশের ক্ষতিসাধন করছে। ছাত্রসমাজ যদি তাদের উদ্যোগী সচেতন মন নিয়ে জনগণকে সচেতন। করে তােলে তাহলে পরিবেশ সংরক্ষণ সম্ভব হবে।

সাংস্কৃতিক অবদান:

সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ছাত্ররা রাখতে পারে অগ্রণী ভূমিকা। সংস্কৃতিচর্চার মাধ্যমে তারা বিশ্বের দরবারে। নিজেদের জাতীয় পরিচয় তুলে ধরতে পারে। আবার সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা; কাব্য, নাটক, প্রবন্ধ, গল্প-উপন্যাস ইত্যাদি চর্চার মাধ্যমে বিশ্ব সাহিত্যের দরবারে তারা ঘােষণা করতে পারে নিজেদের গৌরবােজ্জ্বল উপস্থিতি।

উপসংহার:

প্রত্যেক মানুষের জীবনে ছাত্রজীবন সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য সময়। কেননা এ সময়টা একাধারে ছাত্রদের জীবন গঠন ও দেশ গঠনের লক্ষ্যে পরিচালিত। অধ্যয়নের ফাঁকে ফাঁকে ছাত্রদের দেশব্রতী ভূমিকা পালনই তাদের ভবিষ্যতের দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলবে। দেশ ও সমাজের কল্যাণে ছাত্রদের নানামুখী অবদানই একটা সমৃদ্ধ দেশ ও জাতি গড়ে তুলতে পারে। সমস্যাপীড়িত দারিদ্রসম দেশমাতৃকাকে গড়ে তােলার ক্ষেত্রে ছাত্রসমাজই রাখতে পারে অগ্রণী ভূমিকা। এ প্রসঙ্গে গান্ধীজি বলেছেন, ‘The students are the future leaders of the country who could

নিরক্ষরতা দূরীকরণে ছাত্রসমাজ

  • ভূমিকা
  • বাংলাদেশে নিরক্ষরতার স্বরূপ
  • নিরক্ষরতা দূরীকরণ ও ছাত্রসমাজের ভূমিকা
  • উপসংহার

ভূমিকা:

যেসব সমস্যা বাংলাদেশের উন্নয়ন ও প্রগতিকে ব্যাহত করছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নিরক্ষরতা। ইউনেস্কোর এক পরিসংখ্যানে প্রকাশ, বিশ্বে প্রায় একশ কোটি লােক নিরক্ষর। এদের অধিকাংশই উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশের বাসিন্দা। আধুনিক সমাজে নির হচ্ছে জাতীয় জীবনের সবচেয়ে বড় অভিশাপ। এ অভিশাপের ক্ষমতা এতই প্রখর যে, তা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকেও স্থবির করে দেয়। আর শিক্ষা হলাে জ্ঞানের আলাে। এ আলাে ছাড়া কোনাে অর্থসামাজিক সাংস্কৃতিক উন্নয়ন সম্ভব হয় না, দেশ পৌছাতে পারে না তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে। তাই দেশের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে নিরক্ষরতা দূরীকরণের ব্যাপারটিকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। আর এ লক্ষ্যে এগিয়ে আসতে হবে দেশের সরকার, শিক্ষিত সমাজ, বিশেষ করে দায়িত্বশীল ছাত্রদের।

বাংলাদেশে নিরক্ষরতার স্বরূপ:

বাংলাদেশের প্রায় এক তৃতীয়াংশ মানুষ এখনাে নিরক্ষরতার অন্ধকারে নিমজ্জিত। এখানে শিক্ষিতের হার মাত্র ৭৩.৯ শতাংশ। শিক্ষার আলাে থেকে বঞিত এই জনগােষ্ঠী অজ্ঞানতা, কুসংস্কার আর পশ্চাৎপদতার স্বাধীন জাতির জন্যে মর্যাদাহানিকর তাে বটেই, এক বিশাল বােঝাও। এদের নিয়ে কোনাে উন্নয়ন পরিকল্পনা অলীক স্বপ্নমাত্র। সমাজ,

ছাড়া দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। আর এ নিরক্ষরতা দূরীকরণে সবচেয়ে অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখতে পারে তরুণ ছাত্রসমাজ শিকার।এরা প্রগতিবিমুখ বিজ্ঞানের এচরম উৎকর্ষের যুগেও এরা অন্ধকারে নিমজ্জমান। পিছিয়ে পড়া এ বিশাল জনগােষ্ঠী তাই দেশ ও জাতির সার্বিক উন্নয়নের জন্যে দেশের জনগণকে শিক্ষিত করে তােলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

নিরক্ষরতা দূরীকরণ ছাত্রসমাজের ভূমিকা:

বর্তমানে পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশের জনগােষ্ঠীই অতীতে কম-বেশি নিরক্ষর ছিল। আজকের উন্নত রাশিয়ায় বিপ্লবের আগে শতকরা আশিভাগ লােক ছিল নিরক্ষর । বর্তমানে সেদেশে শিক্ষিতের সংখ্যা শতকরা একশ ভাগ। অতীতে তুরস্ককে বলা হতাে ইউরােপের ‘রুগণ দেশ। কিন্তু তুরস্কের অগ্নিসন্তান কামাল পাশার নেতৃত্বে মাত্র বিশ বছরে তুরস্ক তার শিক্ষামান শতকরা আশি ভাগে উন্নীত করেছে। দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্যে স্বাক্ষরতার কোনাে বিকল্প নেই। শিক্ষিত জনগােষ্ঠীই নিজ ও দেশের উন্নয়নে সচেষ্ট হয়। সমাজের রীতি-নীতি মেনে চলে সুশৃঙ্খল সমাজ গঠনে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। ইতিহাস সাক্ষী, কালে-কালে যুগে-যুগে পৃথিবীর দেশে-দেশে যেকোনাে বৈপ্লবিক পরিবর্তনে তরুণ ছাত্রসমাজ এগিয়ে এসেছে সবার আগে। দেশের স্বাধীনতা, অগ্রগতি আর কল্যাণ সাধনে যেকোনাে বাধা-বিপত্তি ডিঙিয়ে তারা ঝাপিয়ে পড়ে। ছাত্রসমাজই যেন মুক্তির অগ্রদূত। তাই নিরক্ষরতা দূরীকরণেও ছাত্রসমাজই জাতির আশ্রয়। তবে এর জন্যে চাই উপযুক্ত ও বাস্তব পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে সরকারি পৃষ্ঠপােষকতা । এ প্রেক্ষাপটে সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন: প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বয়স্ক শিক্ষাব্যবস্থার, গণশিক্ষার জন্যে গ্রামে খােলা হয়েছে গণশিক্ষা কেন্দ্র। এ ধরনের উদ্যোগ কার্যকর করতে হলে প্রয়ােজন নিরক্ষরদের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি এবং কর্মোদ্যোগ। আর এ দায়িত্ব নিতে পারে ছাত্রসমাজ। এক্ষেত্রে যেসব পরিকল্পনা নিয়ে এগােতে হবে

১. নিরক্ষরতার নেতিবাচক দিক সম্পর্কে নিরক্ষর জনগােষ্ঠীকে সঠিকভাবে অবহিত করতে হবে। গণমুখী প্রচারের মাধ্যমে তাদের মধ্যে জাগিয়ে তুলতে হবে সচেতনতা। এ কাজে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকতে পারে ছাত্ররা।

২. বয়স্ক নিরক্ষরদের শিক্ষাদানের জন্যে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে পাড়ায়-পাড়ায় নৈশ বিদ্যালয় স্থাপন করা যেতে পারে।

৩. এছাড়া প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলােকেও নৈশ বিদ্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এক্ষেত্রে সরকার কিংবা সমাজ প্রয়ােজনীয় উদ্যোগ নিলে ছাত্রসমাজ নিরক্ষরদের বিদ্যালয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করার জন্যে প্রয়ােজনীয় ভূমিকা পালন করতে পারবে।

যেসব এলাকায় শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই, সেসব এলাকায় অস্থায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু করে ছাত্ররা শিক্ষকের ভূমিকা পালন করতে পারে ।

৪. পরিবারে কোনাে সদস্য, এমনকি কাজে সহায়তাকারী কেউ যদি নিরক্ষর থেকে থাকে তবে অবসরে ছাত্ররা তাকে স্বাক্ষর করে তুলতে সহযােগিতা করতে পারে।

৫. পর্দানসীন নারীদের শিক্ষাদানের জন্যে ছাত্রীরা বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।

৬. সর্বোপরি দেশ থেকে নিরক্ষরতা সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করার জন্যে নির্দিষ্ট সময়সীমা সামনে রেখে প্রয়ােজনীয় সরকারি ও বেসরকরি পদক্ষেপ নিলে দেশ গঠনমূলক এ কাজে ছাত্রদের জন্যে সহায়ক ভূমিকা পালন করা সহজ হবে।

উপসংহার:

শিক্ষিত ছাত্রসমাজ নিজ পরিবার থেকে শুরু করে সারাদেশে শিক্ষা বিস্তারে প্রয়ােজনীয় ভূমিকা পালন করতে পারে। শুধু নিজে শিক্ষিত হলে চলবে না, শিক্ষার মহান শিখা ছড়িয়ে দিতে হবে দেশের আনাচে-কানাচে– এ সচেতনতাবােধে উদ্বুদ্ধ হতে হবে ছাত্রদের শিক্ষিত কর্মজীবী-পেশাজীবী সকলের হাতেই রয়েছে জ্ঞানের প্রদীপ। কিন্তু ছাত্রসমাজ সচেতনভাবে এগিয়ে এলে দেশ নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে।

নদীমাতৃক বাংলাদেশ রচনা

  • ভূমিকা
  • মানব সভ্যতায় নদনদীর প্রভাব
  • বাংলাদেশের নদনদী
  • বাংলাদেশের রূপ-বৈচিত্র্যে নদনদী
  • বাংলাদেশের জনজীবনে নদনদীর ইতিবাচক প্রভাব
  • বিরূপ প্রভাব
  • বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নদীর ভূমিকা
  • বাংলা সংস্কৃতিতে নদনদীর প্রভাব
  • উপসংহার

ভুমিকা:

প্রকৃতির বিচিত্র দানে অপরূপ শােভায় সজ্জিত হয়েছে বাংলাদেশ। এ দেশের অবস্থান ঠিক সমতল নয় বরং সাগরপৃষ্ঠ থেকে ক্রমশ উঁচুতে চলে গেছে। তাছাড়া এটিই পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ। বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন এ দেশটি প্রাকৃতিক রূপ-বৈচিত্র্যে অনন্য। এদেশে রয়েছে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। ভৌগােলিক স্বাতন্ত্র্য দেশটিকে যেমনভাবে বিশ্ব মানচিত্রে বিশেষভাবে পরিচিত করেছে তেমনি এ দেশের অধিবাসীদের আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও সুদূরপ্রসারী প্রভাব রেখে চলেছে। বাংলাদেশের আড়াআড়ি অবস্থানের ফলে হিমালয় থেকে উৎপন্ন জলের ধারা তার স্বভাবজাত ধর্ম অনুযায়ী এদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। পথিমধ্যে বাংলা নামের এ জনপদকে সমৃদ্ধ করেছে অসংখ্য নদনদী দিয়ে; বাংলা হয়েছে নদীমাতৃক বাংলাদেশ।

মানবসভ্যতায় নদনদীর প্রভাব:

সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকে মানুষের জীবনযাত্রার সাথে নদীর অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। যুগে যুগে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে, মনীষীদের লেখায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে নদনদীর স্তুতি। সভ্যতার বিকাশের ক্ষেত্রে নদীর ভূমিকার দিকটি বিবেচনা করে ওয়ার্ল্ড ওয়াচ ইনস্টিটিউটের প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট সান্ড্রা পােস্টাল বলেছেন- মানবসভ্যতার ইতিহাস পানির (নদী ও সাগর) অবদান ছাড়া আলােচনা করা অসম্ভব। বস্তুত, নদীর অবদানেই প্রাণ পেয়েছে মানবসভ্যতা। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতা যেমন— অ্যাসেরীয়, ক্যালডীয়, সিন্ধু, চৈনিক প্রভৃতি থেকে শুরু করে আজকের আধুনিক সভ্যতাগুলাের অধিকাংশই বিভিন্ন নদীর তীরবর্তী অঞলে গড়ে উঠেছে। এ সত্যটি আমাদের দেশের জন্য সমানভাবে প্রযােজ্য।

বাংলাদেশের নদনদী:

বলা হয় তেরােশত নদীর দেশ বাংলাদেশ। হাজারও নদী জালের মতাে ছড়িয়ে রয়েছে পুরাে দেশ জুড়ে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র এগুলাের মধ্যে প্রধান। এছাড়াও তিস্তা, সুরমা, কুশিয়ারা, বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, মধুমতি, করতােয়া, কর্ণফুলী, গড়াইসহ অসংখ্য ছােট বড় নদী আছে এ দেশে। প্রতিটি নদীরই রয়েছে স্বাতন্ত্র। বাংলার জনপদগুলােকে গভীর মমতায় জড়িয়ে রেখেছে এসব নদী ।

বাংলাদেশের রূপবৈচিত্র্যে নদনদী:

বাংলাদেশের বৈচিত্র্যময় রূপময়তার বিশাল একটি অংশ জুড়ে রয়েছে নদী। নদীর বুকে জলের ছন্দময় চলা, পালতােলা নৌকার সৌন্দর্য সৌন্দর্যপিপাসু মানুষের নজর কাড়ে। শরতে নদীর তীরে দেখা মেলে শুভ্র কাশফুলের। নানা ধরনের জীবজন্তুতে নদীর তীর থাকে পরিপূর্ণ। বর্ষায় নদীর দুকূল ছাপিয়ে জলরাশি প্লাবিত করে চারপাশকে। নদীর এমন রূপ বড়ই মােহনীয়। সব মিলিয়ে নদীর অবদানে বাংলাদেশের প্রকৃতি হয়েছে ঐশ্বর্যময়।

বাংলাদেশের জনজীবনে নদনদীর ইতিবাচক প্রভাব:

আবহমানকাল ধরেই বাংলার মানুষের জীবন-জীবিকার সাথে নদীর রয়েছে গভীর মিতালি। অস্ট্রিক জাতির লােকেরা পূর্ব ও মধ্য ভারতে প্রথম কৃষিকাজ শুরু করে। এর ওপর ভিত্তি করেই তারা সংঘবদ্ধ হয়ে সুসভ্য জীবনের সূত্রপাত করে। তারা ধান, পান, কলা ও নারকেল চাষ করত যা আজও বাংলার সংস্কৃতিত গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। এ সবকিছুর মূলেই রয়েছে নদীর অবদান। এর বাইরেও প্রাচীনকাল থেকে ভাত-মাছ। বাংলার মানুষের প্রধান খাদ্য হওয়ার মূল কারণ এদেশের নদীমাতৃকতা। ধান চাষের প্রধান উপকরণ হচ্ছে পানি। আর প্রাগৈতিহাসিককাল থেকে চাষাবাদের জন্য এ অঞ্চলে পানির প্রধান চাহিদা মিটিয়েছে নদী। অন্যদিকে, আমাদের নদ- নদীগুলাে সারাবছর ধরে জোগান দিচ্ছে প্রয়ােজনীয় মাছের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। পদ্মা-মেঘনার ইলিশের রয়েছে বিশ্বজোড়া খ্যাতি। নদীর আশীর্বাদ নিয়ে জেলে সম্প্রদায় যুগ যুগ ধরে টিকে আছে। তাছাড়া যােগাযােগ ও পণ্য পরিবহনেও নদীপথ অত্যন্ত জনপ্রিয়।

বিরূপ প্রভাব:

নদীর বৈচিত্র্যময় আচরণের কারণে জনজীবনেও দেখা দেয় নানা পরিবর্তন। নদী থেকে যে মাছ পাওয়া যায় তা আমাদের আমিষের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সাহায্য করছে। চর দখল সংস্কৃতিও নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। নদীভাঙনের শিকার মানুষগুলাে শহরমুখাে হয়ে তৈরি করেছে বস্তি সমস্যা, বাড়াচ্ছে সামাজিক সংকট। পদ্মা ও যমুনার ভাঙনে গৃহহারা মানুষ দলে দলে ভিড় করছে শহরগুলােতে। বদলে যাচ্ছে শহরের জনসংখ্যার অনুপাত। নদীর আরেকটা বিরূপ প্রভাব হলাে বন্যা। আমাদের দেশে প্রায় প্রতি বছরই ফলে আঘাত হানে বন্যা। এর ফলে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় ।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নদীর ভূমিকা:

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নদীর ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। বাংলার মানুষের যােগাযােগের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে নদী। নদীভাঙন ও বন্যার কারণে ঘরবাড়ি হারানাে কর্মহীন মানুষ শহরে ভিড় করায় শহরে সুলভ মূল্যে শ্রম মিলছে। পানীয় জলের সবচেয়ে বড় উৎস নদী। নদী থেকে প্লাবনের সাথে ভেসে আসা পলি এদেশের মাটিকে করেছে উর্বর। সুলভে শ্রমিক প্রাপ্তির সামাজিক পরিবর্তনের প্রভাব থেকে বাদ যাচ্ছে না শহরের অর্থনৈতিক কাঠামােও। সুভ শ্রমিকের উপস্থিতি শিল্পনির্ভর শহরের উৎপাদনক্ষেত্রে যে প্রভাব রাখছে, তা নতুন ধরনের সামাজিক শ্রেণীকরণ, জনসংখ্যার বণ্টন ও আর্থসামাজিক পরিমণ্ডল তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এভাবে নদী বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনাচারে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে চলেছে।

বাংলা সংস্কৃতিতে নদনদীর প্রভাব:

বাংলা ও বাঙালির সংস্কৃতি প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে নদীকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। সংস্কৃতিকে যদি সমাজের প্রতিচ্ছবি ধরা হয়, তাহলে সমাজের যত বিষয় রয়েছে এর প্রায় সবই নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। এদেশের যে সংস্কৃতি নানা ভাঙা গড়ার মধ্য দিয়ে বর্তমান অবস্থায় এসে পৌছেছে তা প্রধানত কৃষিজীবী সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে নদী। নদীর প্রভাব উঠে এসেছে এ অঞ্চলের মানুষের মুখের ভাষায়ও। তাছাড়া প্রবাদ প্রবচন, প্রতিদিনের বাক্যালাপ, পারিবারিক-সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়ােজন থেকেও বাদ যায় না নদী। এমনকি বাংলা সাহিত্যের বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে এদেশের বিভিন্ন নদনদী। নদীকেন্দ্রিক জীবন-সংস্কৃতির কারণেই এদেশে ভাটিয়ালি ও সারি গানের বিপুল সম্ভার গড়ে উঠেছে। এছাড়া বাংলা সংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ পােশাক-পরিচ্ছদও বহুলাংশে নদী দ্বারা প্রভাবিত। নদীকেন্দ্রিক কৃষি ব্যবস্থায় কাজে সহায়ক ভূমিকার জন্য লুঙ্গি ও গামছা পেয়েছে একচেটিয়া জনপ্রিয়তা। নদী এ অঞলের পারস্পরিক সম্পর্ক ও সমাজ বিনির্মাণেও অন্যতম ভূমিকা পালন করে আসছে সাগরতীরবর্তী সভ্যতায়। কৃষিকাজের ব্যবহার সীমিত বলে মানুরে মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা কম। অন্যদিকে, বাংলায় নদীকেন্দ্রিক কৃষি ব্যবস্থায় পানি সেচের প্রয়ােজনে দলবদ্ধভাবে কাজ করতে হয়। এতে করে মানুষ দলগত চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়। এদিক থেকে। দেখলে আমাদের সামাজিক বন্ধন, দলবদ্ধ হয়ে কাজ করার প্রবণতা, দেশপ্রেম, রাষ্ট্রচিন্তা থেকে শুরু করে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণববিষয়কে নানা দিক থেকে প্রণােদিত করেছে নদী ।

উপসংহার:

শরীরের রক্তধারার মতােই যেন বাংলাদেশের নদী এদেশকে বাঁচিয়ে রেখেছে। সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা করে তুলেছে এদেশকে। পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে অনেক নদী হারিয়েছে তার যৌবন। অনেক নদীই আজ লুপ্তপ্রায়। অথচ একসময় নদী তীরবর্তী সভ্যতা হিসেবেই এদেশে জনপদ গড়ে উঠেছিল। কালের প্রভাবে নদীগুলাে জৌলুস হারালেও আজ অবধি সেগুলাে নানাভাবে এদেশের প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে। আর তাই নদী না বাঁচলে যে বাংলাদেশ বাঁচবে না তাতে কোনাে সন্দেহ নেই। এজন্য বাংলার প্রকৃতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির স্বার্থেই নদীগুলােকে রক্ষা করতে সবাইকে সচেষ্ট হতে হবে।

বাংলাদেশের শীতকাল

  • ভূমিকা
  • বাংলাদেশে শীতকাল
  • শীতের সকাল
  • গ্রামীণ জীবনে শীতকাল
  • নগরজীবনে শীতকাল
  • শীতের বিশেষ আকর্ষণ
  • উপসংহার

ভূমিকা:

ঋতুবৈচিত্র্যের দেশ বাংলাদেশ। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত এ ষড়ঋতু বাংলায় বয়ে আনে রকমারি রূপ। ঋতু আসে, ঋতু যায় প্রকৃতি সাজে নানারঙে নানা সাজে। কবির ভাষায়-

‘ঋতুর দল নাচিয়া চলে।

ভরিয়া ডালি ফুল ও ফলে,

নৃত্যলােকে চরণতলে মুক্তি পায় ধরা

ছন্দে মেতে যৌবনেতে রাঙিয়া উঠে জরা।

এমনই এক ধারাবাহিকতায় হেমন্তের পর আসে শীত। শীত বাংলাদেশে আসে রিক্ততার রূপ ধারণ করে। বন-বনানীর পাতা ঝরার বার্তা বয়ে আনে শীতকাল।

বাংলাদেশে শীতকাল:

পৌষ ও মাঘ এ দু মাস শীতকাল । এ ঋতু অনেকেরই প্রিয় ঋতু। এ ঋতুর তুলনা হয় না। শীতকালে আমাদের দেশে বৃষ্টিপাত হয় না বললেই চলে। ফলে পথঘাটে স্বচ্ছন্দে হাঁটা-চলার আনন্দ পাওয়া যায়। শীতকালে প্রচুর পরিমাণে শাকসবজি পাওয়া যায়। এছাড়া শীতকালে এদেশের মানুষ পিঠাপুলি খেতে ভালােবাসে। শীতের সকালে খেজুর রসের কথা মনে হলে কার না ইচ্ছে করে শীতকালে ফিরে যেতে কবি সুফিয়া কামাল তাই শীতকে স্মরণ করেছেন এভাবে- ‘পৌষ পার্বণে পিঠা খেতে বসে খুশিতে বিষম খেয়ে আরও উল্লাস বাড়িয়াছে মনে মায়ের বকুনি পেয়ে। কুলের কাঁটার আঘাত সহিয়া, কাঁচা-পাকা কুল খেয়ে, অমৃতের স্বাদ যেন লভিয়াছি গাঁয়ের দুলালী মেয়ে।

শীতের সকাল:

শীতের সকাল যেকোনাে সকালের চেয়ে ব্যতিক্রম। গাছের পত্রপল্লবের কোনাে ফাক দিয়ে সকালের সােনা রােদ এসে স্পর্শ করে আমাদের বারান্দা আর উঠোন। শীতের সকালে ঈষদুষ্ণ রােদে বসে শীতের পিঠাপুলিতে সকালের নাশতা করতে সবারই ইচ্ছে হয়। গায়ে চাদর জড়িয়ে মেঠো পথে হাঁটতে গেলেই শিশির ভেজা ঘাস পায়ের গােড়ালি ভিজিয়ে দেয়। শিমুল ফুলের লাল পাপড়ির আড়ালে বসে দোয়েল, কোয়েল, ময়না, টিয়ে কিচিরমিচির শব্দ তুলে নেচে ওঠে কলতানে। সূর্যোদয়ের সময় পাখিরা গান গেয়ে গেয়ে শীতের সকালকে স্বাগত জানায়। সমস্ত আয়ােজনটা তখন হয়ে ওঠে প্রাকৃতিক। সামনে চোখ বাড়ালেই ফসলহীন শূন্য মাঠ, পাতাঝরা শূন্য গাছ দেখে তখন মনে হয় প্রকৃতি যেন অভিমান করে ছুড়ে ফেলেছে তার পুরাতন সাজ । কবি কণ্ঠে ধ্বনিত হয়— ‘শীতের হাওয়ার লাগল নাচন আমলকির এই ডালে ডালে। পাতাগুলি শিরশিরিয়ে ঝরিয়ে দিল তালে তালে। গাঁদা, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা আর সূর্যমুখীর গায়ে কাঁচা রােদের কোমল স্পর্শে যে ঝকঝকে সুন্দরের  বিচ্ছুরণ ঘটে তা সত্যিই শীতের সকাল ছাড়া অন্য কোনাে সময়ে অবলােকন অসম্ভব ।

গ্রামীণ জীবনে শীতকাল:

গ্রামের অধিকাংশ মানুষ পেশাগত দিক থেকে কৃষির সাথে জড়িত। তাই শীতের সকালেও তাদের শীতের আরাম ও আনন্দকে উপভােগ করার সময় থাকে না শীতের কুয়াশা ভেদ করে লাঙল নিয়ে তারা হােটে ফসলের মাঠে। শীতকাল ইরি ধান রােপণের প্রধান সময়। এ সময়ে কৃষকের বসে থাকলে চলে না। অন্যদিকে, কৃষাণী বধূরাও সবজি ক্ষেতে শুরু করে পরিচর্যা, আবার কেউ তােলে শাকসবজি। শীতের কনকনে ঠান্ডা বার্ধক্য, পীড়িতদের খানিকটা বেশিই চেপে ধরে। তাই ভাের হলেই খড়কুটোর আগুন জ্বালিয়ে তারা উষ্ণ করে নেয় তাদের শরীর। এ সময় শিশুরাও এসে যােগ দেয়। আগুন পােহানাের কাজে। আর মাঝে মধ্যে চলতে থাকে রসপূর্ণ গল্পকথা। ওদিকে পিঠা বানানাের ধুম পড়ে যায় রান্নাঘরে।গরম গরম পিঠা আর মিঠে রােদ সব মিলিয়ে যেন অভূতপূর্ব আনন্দের আয়ােজন।

নগরজীবনে শীতকাল:

নগরজীবনে সাধারণত শীতকে উপভােগ করার সুযােগ কম। নগরের উঁচু তলার মানুষেরা গরম কম্বল জড়িয়ে ঘুমিয়ে কাটায় শীতের প্রভাত। ফলে তাদের পক্ষে সকালের কুয়াশাচ্ছন্ন সুন্দর রূপ অবলােকন সম্ভব হয় না। অন্যদিকে, চাকরিজীবী ও নিম্নবিত্ত মানুষ অফিসে আর কাজে বেরিয়ে পড়ে নগরের পথে পথে । কুয়াশা ভেদ করে ছুটে চলে তারা নিজ নিজ গন্তব্যে। জীবনের ব্যস্ততা চোখে পড়ে নিয়ত । গাড়িগুলাে দিনের বেলাতেও হেডলাইট জ্বালিয়ে ছুটে চলে অবিরাম। এখানে শিশিরে পা ভেজে না, পিঠার গন্ধে বাতাস ব্যতিক্রম হয়ে ওঠে না। দরিদ্র এ দেশে শীত বস্তিবাসীর জন্যে নিয়ে আসে দুর্ভোগ। নগরে ভাসমান মানুষ হয় শীতের নির্মম শিকার। বাস্তুহীন শিশু-বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ফুটপাতে, রেলস্টেশনে গরম কাপড় ছাড়াই প্রচণ্ড শীতের সাথে লড়াই করে।

শীতের বিশেষ আকর্ষণ:

শীতকাল বাংলাদেশের জন্যে বিশেষ একটি আকর্ষণের সুযােগও সৃষ্টি করে দেয়। শীতকালে বৃষ্টিপাত থাকে না বলে প্রাকৃতিক পরিবেশ থাকে স্বাভাবিক। শীত তাই অবকাশের ঋতু, বেড়ানাের ঋতু। এ সময় সাগর থাকে শান্ত। তাই ভ্রমণপিপাসু পর্যটক যান কক্সবাজার সমুদ্র দর্শনের ব্যাকুল বাসনা মানুষকে অস্থির করে তােলে। তাই শীতকালকেই বেছে নেন তারা সমুদ্রবিলাসের সময় হিসেবে। সমুদ্রসৈকতে দাঁড়িয়ে শীতের সূর্যাস্ত দেখার অনুভূতিটাই আলাদা। পৃথিবীতে যেন কোনাে ঐশ্বরিক সৌন্দর্য এসে ধরা দেয় তখন। তাই সমুদ্রদশী মানুষের কাছে শীতের আবেদন বড়ই রোমাঞকর।

উপসংহার:

বাংলাদেশের শীতকাল আনন্দ ও অবকাশের এক বিশেষ ঋতু। শীত বয়ে আনে ডালিয়া, গাঁদা আর চন্দ্রমল্লিকার ঘ্রাণ। কুয়াশাঘেরা প্রকৃতি তুলে ধরে শিশিরের সৌন্দর্য। রসনাবিলাসী বাঙালি শীতেই লাভ করে পিঠাপুলির তৃপ্তি । আর ভ্রমণবিলাসী মানুষ পায় ভ্রমণের আনন্দ কবির ভাষায় বলা যায়- ‘ঘন শিশির মাখা মেঠো ঘাসের পথ ধরে। হাজার বছর ধরে শীত কন্যা নাইয়রির বেশে আসে এ দেশে, আসবে, গ্রাম-বাংলার জনপদে।’

একুশের বই মেলা

  • ভূমিকা
  • বইমেলার ইতিহাস
  • বাংলাদেশে বইমেলা
  • বইমেলার তাৎপর্য
  • বইমেলার প্রভাব
  • বইকেনার আগ্রহ বৃদ্ধি ও পাঠক সৃষ্টি
  • লেখক, প্রকাশক ও ক্রেতার মিলনস্থল
  • আনন্দ আয়ােজনে বইমেলা
  • একুশের বইমেলা
  • বইমেলা রচনা

ভূমিকা:

বিশ্বের যেকোনাে দেশের ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির বিস্তার ও বিকাশে বইমেলার রয়েছে অনন্য ভূমিকা । আধুনিক রুচিশীল মানুষ তাদের চিন্তা ও মননের সঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছে বইকে। তাই সংস্কৃতির বিকাশে বইমেলা হয়ে উঠেছে। অন্যতম আধুনিক মাধ্যম। সমাজের সবধরনের মানুষের মধ্যে ব্যবধান ঘুচিয়ে একই প্লাটফর্মে একই প্রাণের উৎসবে বইমেলা মাতিয়ে তােলে সবাইকে। বাঙালির জাতীয় জীবনেও বইমেলা একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, একটি অনন্য উৎসব।

বইমেলার ইতিহাস:

ছাপাখানা ও বইয়ের ইতিহাস অনেক পুরােনাে হলেও বইমেলার বয়স সে তুলনায় বেশি নয়। সম্ভবত ১৪৮০ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ডে একটি সাধারণ মেলার অংশ হিসেবে বই প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কাল থেকেই বইমেলা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে বিশ্বাসনে। তবে সর্বপ্রথম পূর্ণাঙ্গ বইমেলার আয়ােজন করা হয় নিউইয়র্কে ১৮০২ সালে । এর পূর্ব পর্যন্ত বাণিজ্যিক পণ্য প্রদর্শনীর পাশাপাশি বই প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হতাে। ১৯২৪ সালে এককভাবে বই নিয়েই আয়ােজিত হয় লাইপজিগের বইমেলা। বর্তমান সময়েও লাইপজিগ বইমেলা জনপ্রিয়তার শীর্ষে। এভাবেই ধীরে ধীরে

বইমেলার পরিধি বিস্তৃত হয়ে পড়ে। তবে আয়ােজন ও জনপ্রিয়তার ক্ষেত্রে আরও কিছু উল্লেখযােগ্য নাম হলাে ফ্রাঙ্কফুট, লন্ডন, কায়রাে, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি বইমেলা।

বাংলাদেশে বইমেলা:

বাংলাদেশে বইমেলার ইতিহাস বেশি দিনের নয়। ১৯৫৫ সালে বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার পর থেকে বইমেলার অঙ্কুর গজাতে শুরু করে। তবে একটি সুপরিকল্পিত ও সুসজ্জিত বইমেলার সূচনা হয় মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে। মহান একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষ্যে নানা সভা-সমিতি ও অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়েই একটি পূর্ণাঙ্গ বইমেলার উদ্ভব ঘটে। ১৯৭২ সালে এ অনুষ্ঠানের সঙ্গে একাডেমির নিজস্ব বইপুস্তক, জার্নাল বিক্রি এবং পােস্টার, ছবি, বুলেটিন, পত্রপত্রিকা, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের নিষিদ্ধ বুলেটিন ও ইশতেহার প্রদর্শনের সূচনা হয়। তবে বইমেলার সূচনাকালের মাইলফলক হিসেবে ১৯৭৪ সালে অনুষ্ঠিত স্বাধীন দেশের প্রথম জাতীয় সাহিত্যসম্মেলনকে ধরা হয়। ১৯৭৫ সালে মুক্তধারা নিজেদের উদ্যোগে প্রথম পূর্ণাঙ্গ বইমেলার আয়ােজন করে। ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমি প্রাতিষ্ঠানিক বইমেলার সূচনা করে। ১৯৮৪ সাল থেকে একুশের বইমেলা ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ নামে অভিহিত হয়। সরকারি উদ্যোগে ১৯৯৫ সাল থেকে আয়ােজিত ঢাকা বইমেলা জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। বর্তমানে ঢাকা বইমেলাকে আন্তর্জাতিক মেলার পর্যায়ে উন্নীত করার প্রক্রিয়া চলছে।

বইমেলার তাৎপর্য:

বইয়ের মাধ্যমে বিশ্বের নানা জ্ঞানী ও পণ্ডিত ব্যক্তির চিন্তাচেতনা, অভিজ্ঞতা-উপলব্ধি, দর্শন-ভাবনা ইত্যাদির সাথে পরিচিত হওয়া যায়। বইমেলা এ দুর্লভ সুযােগ সৃষ্টির অনন্য মাধ্যম। বিচিত্র গ্রন্থের সমাবেশ ঘটানাে

বইমেলার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাই বইমেলা বইপ্রেমিকদের গুরুত্বপূর্ণ আশ্রয়। বইমেলাকে কেন্দ্র করে প্রকাশিত হয় নতুন নতুন বই, পত্র-পত্রিকা। ক্রেতার চাহিদা পূরণের জন্যে কালােত্তীর্ণ বইয়ের পুনঃপ্রকাশ ঘটে। লেখক ও পাঠকের সম্মুখ ও সরাসরি যােগাযােগের মাধ্যমে ভাব-বিনিময়ের সুবর্ণ সুযােগ পাওয়া যায়। তাছাড়া লেখক, প্রকাশক, পাঠক, মুদ্রক, বিক্রেতা খােলাখুলি মত প্রকাশের মাধ্যমে নিজেদের সমস্যাকে তুলে ধরার পাশাপাশি বইয়ের প্রচারণাও করতে পারেন। লেখকের সাথে সরাসরি ভাব-বিনিময়ের মাধ্যমে বই পড়ার প্রতি পাঠকের আগ্রহ সৃষ্টি হয়। বিষয়-বৈচিত্র্যের সম্ভার পাঠককে দেয় আবিষ্কারের আনন্দ। সর্বোপরি নানান বয়সের নানান রুচির মানুষের কৌতূহলী মনের ভাব বিনিময়ের মাধ্যমে কমে যায় মনের ব্যবধান। নবীন আর প্রবীণ মনের মিলনে ঘুচে যায় সংস্কৃতির ব্যবধান। সাধারণের মনে পাঠাভ্যাস গড়ে তােলা, শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশেও বইমেলার তাৎপর্য অপরিসীম।

বইমেলার প্রভাব:

বই মানুষের সুকুমার বৃত্তির অনন্য প্রকাশ। তাই মনুষ্যত্বের বিকাশে বইয়ের বিকল্প কিছু নেই। বইমেলা অর্থনৈতিক চিন্তার উর্ধ্বে একটি রুচিশীল আয়ােজন । তাই মানুষকে উন্নত জীবনবােধ ও মনুষ্যত্ববােধে উদ্বুদ্ধকরণে বইমেলার প্রভাব অপরিসীম। সামাজিক ভেদাভেদ ভুলিয়ে দিয়ে ভ্রাতৃত্ববােধের অঙ্গীকার সৃষ্টি করে বইমেলা। এ আয়ােজন একদল সংস্কৃতিবান মানুষের পবিত্র প্রাণের আয়ােজন। তাই সব সংস্কারের উর্ধ্বে উঠে জীবনকে মহৎ আদর্শে সুসংগঠিত করে বইমেলা । খ্যাতিমান লেখকের সাথে সরাসরি কথা বলা, তাদের কণ্ঠে আবৃত্তি শােনার যে আনন্দ ও সুখ তার সুযােগ করে দেয় বইমেলা । তাই বইমেলা সমস্যাসংকুল মানবজীবনে দেয় স্বপ্নময় আনন্দের স্পর্শ।

বইকেনার আগ্রহ বৃদ্ধি পাঠক সৃষ্টি:

যেকোনাে বিষয়কে অবলম্বন করে আনুষ্ঠানিক মেলার আয়ােজন সাধারণের মনে কৌতূহল ও উদ্দীপনার সৃষ্টি করে । বইয়ের ক্ষেত্রেও তেমনি। বইমেলার বিচিত্র বইয়ের সম্ভার পাঠকের মনে আগ্রহ সৃষ্টি করে । রুচিশীল পাঠকমাত্রই চায় বইয়ের মান যাচাই করতে ও পছন্দসই বই কিনতে । বইমেলায় অনেক ধরনের বই থাকে বলে পাঠক এ সুযােগ পায় অনায়াসে। তাছাড়া অন্যান্য সময়ের তুলনায় বইমেলায় কমমূল্যে বই বিক্রি হয় বলে পাঠক বই কেনার আগ্রহ পায় এবং কমমূল্যে বইকেনার সুযােগ কাজে লাগায়। বইমেলার স্টলগুলাের শৈল্পিক সজ্জা এবং আনন্দময় পরিবেশ সর্বসাধারণের মধ্যে বই পড়ার আগ্রহ বাড়ায়। তাছাড়া বইমেলায় যেহেতু বইয়ের প্রচার ও বিক্রি হয় বেশি সেহেতু লেখক ও প্রকাশক ভালাে বই বের করার চেষ্টা করেন। যা বই পাঠে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে। এভাবেই মানুষের আগ্রহ বৃদ্ধির মাধ্যমে বইমেলা আলােকিত সমাজ গড়ায় পালন করে অনন্য ভূমিকা।

লেখক, প্রকাশক ক্রেতার মিলনস্থল:

লেখক-পাঠকের সরাসরি যােগাযােগ মাধ্যম বইমেলা। বয়স, জাতিভেদ কিংবা বর্ণভেদ সবকিছুকে অস্বীকার করে নিঃসংকোচ প্রাণের মিলনমেলা এ আয়ােজন। প্রবীণ লেখকের পাশাপাশি নবীন লেখক, প্রবীণ পাঠকের পাশাপাশি নবীন পাঠক সবারই একই উৎসাহ, একই আগ্রহ। বইমেলা এমন এক আয়ােজন যেখানে একমাত্র লেখক, প্রকাশকদের সাথে ক্রেতাদের সরাসরি সংযােগসাধন সম্ভব। লেখক, প্রকাশক এবং ক্রেতার সমাবেশ বিক্রেতাকে করে উৎসাহিত । এককথায় ভাববিনিময়, সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানে বইমেলা লেখক, প্রকাশক, ক্রেতা, বিক্রেতার মিলনক্ষেত্র।

আনন্দ আয়োজনে বইমেলা:

বইমেলা কেবল বিচিত্র বইয়ের সম্ভার নয়, বরং উৎসবমুখর আনন্দপূর্ণ পরিবেশও এর অন্যতম

বৈশিষ্ট্য। মেলায় আসা মানুষকে বাড়তি আনন্দদান এবং উৎসাহ প্রদানের জন্যে এখানে আলােচনা, কবিতা আবৃত্তি, গান-বাজনার ব্যবস্থা করা হয়। প্রখ্যাত লেখক এবং খ্যাতিমান ব্যক্তিরা এসব আয়ােজনে অংশ নেন। সাহিত্যিক আলােচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, লেখক-প্রকাশকদের আড্ডা সব মিলিয়ে বইমেলা হয়ে ওঠে উৎসবমুখর।

একুশের বইমেলা:

সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বইয়ের জন্যে অন্যান্য মেলার আয়ােজন করা হলেও এখন পর্যন্ত অমর একুশে বইমেলাই লেখক, প্রকাশক, বিক্রেতা এবং পাঠকদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্ববহ সৃজনশীল ও গবেষণাধর্মী লেখক ও পাঠকদের কাছে ফেব্রুয়ারি মাসব্যাপী বইমেলাটি তীর্থ উৎসবে পরিণত হয়। একুশে বইমেলার সাথে যুক্ত থাকে বাঙালির আবেগ ও জাতীয় চেতনা। জনপ্রিয়তার ফলে ঢাকার বাইরে দেশের অন্যান্য বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলােতেও একুশে বইমেলার আয়ােজন করা হয়। বাঙালির জাতীয় ঐতিহ্য রক্ষায় এ মেলার রয়েছে অগ্রণী ভূমিকা।

উপসংহার:

বইমেলা একটি সৃজনশীল প্রেরণা সংস্কারমুক্ত, মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন সচেতন জাতি গঠনে বইমেলা পালন করে অপরিহার্য ভূমিকা। বইমেলা বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। একদিকে যে বাঙালি সংস্কৃতির লালন করছে, অন্যদিকে মানবমনে সম্মিলনী চেতনার সঞার করছে।

মানবকল্যাণে বিজ্ঞান

  • ভূমিকা
  • বিজ্ঞানের কল্যাণধর্মী অবদান
  • চিকিৎসাক্ষেত্রে বিজ্ঞান
  • যােগাযােগের ক্ষেত্রে বিজ্ঞান
  • বিজ্ঞানের বিস্ময় কম্পিউটার
  • মানবকল্যাণে বিদ্যুৎ
  • বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক প্রভাব
  • উপসংহার

» বিজ্ঞানের জয়যাত্রা » বিজ্ঞান ও আধুনিক জীবন » দৈনন্দিন ও প্রাত্যহিক জীবনে বিজ্ঞান » সভ্যতার অগ্রগতিতে বিজ্ঞানের অবদান » মানবকল্যানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি » বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

ভূমিকা:

বিজ্ঞান আজকের বিশ্বের মানুষের কাছে খুলে দিয়েছে বিস্ময়কর সাফল্যের দ্বার। মানুষের জীবনকে সহজ থেকে আরও সহজ করে তােলার কাজে বিজ্ঞানের অবদান সবার ওপরে । আজকের মানবজীবন বিজ্ঞাননির্ভর। মানুষের কর্মপদ্ধতি এখন বিজ্ঞান নিয়ন্ত্রিত। মানুষ এখন সমৃদ্ধির স্বপ্ন দেখছে বিজ্ঞানকে ভিত্তি করেই । দিনে দিনে বিজ্ঞান তার আবিষ্কারকে অব্যাহত রেখেছে আর সাধিত হচ্ছে মানবকল্যাণ। মানবের সেবা ও কল্যাণে বিজ্ঞান সদা তৎপর।

বিজ্ঞানের কল্যাণধর্মী অবদান:

পৃথিবীর মানুষ একদিন বিজ্ঞান সাধনায় মনােনিবেশ করেছিল তার নিজের প্রয়ােজনে। নিজের প্রয়ােজন ও সুখকর জীবনের তাগিদ থেকেই বিজ্ঞানের চর্চা আজও প্রবহমান। মানুষ সাধনা করে সে বিজ্ঞান থেকে আবিষ্কারগুলােকে ঘরে তুলেছে তা মানব বসতির সকলের মঙ্গল ও কল্যাণের জন্যই । জীবনের সর্বক্ষেত্রে বিজ্ঞানের আছে তাই গৌরবজনক অবদান। বিজ্ঞানের কোনাে আবিষ্কার বা অবদান যদি মানুষের হিতে ব্যয়িত না হয়ে অকল্যাণে ব্যয়িত হয়। তাহলে সে দোষ বিজ্ঞানের হবার কথা নয়। মানুষ নিজেকে সবচেয়ে বেশি ভালােবাসে। অতএব, নিজের জন্য যে উদ্ভাবন তা নিঃসন্দেহে কল্যাণের সাথেই সম্পৃক্ত। বিজ্ঞানের নানা আবিষ্কারের বর্ণনার মধ্য দিয়ে মানবকল্যাণের সাথে এর সম্পৃক্ততাকে তুলে ধরতে আমরা সচেষ্ট হব।

চিকিৎসাক্ষেত্রে বিজ্ঞান:

মানুষ অসুখে পতিত হয়। এ অসুখ থেকে মুক্ত হয়ে সে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে চায়। এক্ষেত্রে বিজ্ঞান মানুষকে বাচতে সাহস যুগিয়েছে। মরণব্যাধি যক্ষ্মা ও ক্যান্সারের মতাে রােগের প্রতিষেধক ও ওষুধ আবিষ্কার করে মানুষ চিকিৎসা বিজ্ঞানে আলােড়ন সৃষ্টি করেছে। মানুষের পক্ষে কোনােকালেই মরণকে জয় করা সম্ভব নয়। কিন্তু অসুখকে জয় করা মানুষের পক্ষে সম্ভব হয়েছে। ওষুধের নব নব আবিষ্কার মানুষকে বাঁচতে প্রাণিত করেছে। মানবজীবনের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সমস্যা যাচাইয়ের জন্য এমন সব প্রযুক্তি মানুষ আবিষ্কার করেছে যার সাহায্যে শরীরের অভ্যন্তরের ছবি উঠিয়ে সঠিক রােগ নিরূপণ সম্ভব হচ্ছে। শুধু চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের এ অসীম অবদানের কথা বিবেচনা করলে মানবকল্যাণে বিজ্ঞানের অবদানের কথা সহজেই অনুমান করা যায়।

যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিজ্ঞান:

যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের সাফল্য মানুষের জীবনে পরম শান্তি এনেছে। দ্রুতগতিসম্পন্ন ট্রেন আবিষ্কার করে মানুষ হাজার কিলােমিটারের পথকে করেছে নিকট। অত্যাধুনিক কনকর্ড বিমান, সাগরের সুবিশাল জাহাজ মানুষের পথের দূরত্বকে কমিয়েছে বিস্ময়করভাবে। আধুনিক টেলিযোগাযোগে তো বিজ্ঞানের বিরাট সাফল্য। মিনিটের মধ্যে গােটা বিশ্বের যেকোনাে প্রান্তের সংবাদ নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে এক স্থানের কোনাে ছবি মােবাইলের বাটন চেপে বীর অন্য প্রান্তে পৌছে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। মানুষের জীবনের পরতে পরতে প্রবেশ করেছে বিজ্ঞান । বিজ্ঞান এখন মহাকাশেই শুধু ব্যস্ত নয়। ক্ষুদ্র গৃহকোণেও বিজ্ঞান এখন সেবা দিয়ে যাচ্ছে নিরন্তর।

বিজ্ঞানের বিস্ময় কম্পিউটার:

যেদিন বিজ্ঞান পৃথিবীকে কম্পিউটার দিয়েছে সেদিন থেকে পৃথিবী তার পুরাতন চেহারাকে বদলে ফেলতে সক্ষম হয়েছে। সকল কাজের কাজী কম্পিউটার। যে কাজ শত শ্রমিকের হাজার ঘণ্টা শ্রমের দ্বারা সম্ভব হতাে সে কাজ মিনিটে করা সম্ভব হচ্ছে কম্পিউটারের কল্যাণে। মানব শ্রমের এ সাশ্রয় পৃথিবীর জন্য একটি বড় ঘটনা বৈকি! কম্পিউটারকে কেন্দ্র করে এখন শুধু কঠিন কাজই যে সহজ হচ্ছে তা নয়, অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করার জন্যে কম্পিউটার মহানায়ক। মুদ্রণ কাজ থেকে মহাকাশ গবেষণা – এমন কোনাে কাজ নেই যে কাজের সাথে কম্পিউটার যুক্ত নয়।

মানবকল্যাণে বিদ্যুৎ:

শহরে, নগরে গ্রামে ও পথে-প্রান্তরে যত বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলে তা বিজ্ঞানেরই এক বিস্ময়কর অবদান। পৃথিবীর সভ্যতাকে হাজার বছরের পথ এগিয়ে দিয়েছে এ বিদ্যুৎ। বর্তমান বিদ্যুৎসম্পন্ন পৃথিবী আর বিদ্যুহীন একটি পৃথিবী কল্পনা করতে গেলে বিদ্যুতের অবদানকে সহজে অনুমান করা যায়। বিদ্যুহীন একটি দিনও কল্পনা করতে গেলে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। তাই মানবকল্যাণে বিদ্যুতের বা বিজ্ঞানের এ অবদানকে অস্বীকার করার কোনাে সুযােগ নেই।

বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক প্রভাব:

সাম্প্রতিক সময়ে বিজ্ঞান অনেক দূর অগ্রসর হতে পেরেছে। পৃথিবীতে বিজ্ঞান যত বেশি অগ্রসর হবে মানবকল্যাণ তত বেশি সাধিত হবে । পৃথিবীকে ধ্বংস করার জন্য বিজ্ঞানীরা বিজ্ঞান নিয়ে মেতে ওঠেনি। বরং এর কল্যাণকর দিকটির শতভাগ সেবা পাবার জন্য এর শুভযাত্রা সূচিত হয়েছিল। মানুষের শুভবুদ্ধি এবং বিজ্ঞান চর্চা অনাগত দিনেও অব্যাহত থাকবে এবং এর সুফলও মানুষ ভােগ করবে সন্দেহ নেই।

উপসংহার:

বিজ্ঞান উত্তরােত্তর সমৃদ্ধির পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে আর মানবসমাজ ভােগ করছে এর সুফল। পৃথিবী যতদিনথাকবে ততদিন কৌতূহলী মানুষ অনুসন্ধানী মনে বিচরণ করে যাবে বিজ্ঞানের মাঠে। মানুষের এ সাধনার মধ্যেই নিহিত আছে– জগৎ মানবের বৃহত্তর কল্যাণ।

দৈনন্দিন জীবনে কম্পিউটার

কম্পিউটার বিজ্ঞানের এক বিস্ময়, কম্পিউটার রচনার সংকেত

  • ভূমিকা
  • কম্পিউটারের ধারণা
  • ইতিহাস ও বিবর্তন
  • বাংলাদেশে কম্পিউটার
  • আধুনিক জীবন ও কম্পিউটার
  • কম্পিউটার ও বেকারত্ব
  • কম্পিউটার ও শিক্ষা
  • কম্পিউটার ও শিল্পবাণিজ্য
  • কম্পিউটার ও কৃষি
  • উপসংহার

কম্পিউটার বিজ্ঞানের এক বিস্ময়, কম্পিউটার রচনা

দৈনন্দিন জীবনে কম্পিউটার » কম্পিউটার » আধুনিক জীবনে কম্পিউটার » কম্পিউটার ও আধনিক সভ্যতা » কম্পিউটার ও আধুনিক বিশ্ব » বিংশ শতকের বিস্ময় : কম্পিউটার » কম্পিউটার ও বাংলাদেশ

ভূমিকা:

অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইউরােপসহ সমগ্র বিশ্বে শিল্পবিপ্লবের ছোঁয়ায় মানুষের জীবনে যন্ত্রের প্রভাব বিস্ময়করভাবে পরিলক্ষিত হয় । এই বিস্ময় আরও তীব্র হয়েছে বিংশ শতাব্দীতে মানুষের পৃথিবী ছেড়ে চাঁদে গমন করার অনন্য সাফল্যে । আর এই সাফল্যের পেছনে যে যন্ত্রটি অসামান্য ভূমিকা পালন করেছে তা হলো কম্পিউটার’ । মানুষের মানসিক শ্রম লাঘব করার অসম্ভব দায়িত্ব পালন করছে কম্পিউটার। কম্পিউটার আবিষ্কারের ফলে মানুষ যন্ত্রশক্তির মাধ্যমে দুর্বার শক্তির অধিকারী হয়েছে।

কম্পিউটারের ধারণা:

ল্যাটিন শব্দ ‘কম্পিউট’ (Compute) থেকে কম্পিউটার কথার উদ্ভব। কম্পিউটারকে এক অর্থে যন্ত্র মস্তিষ্কও বলা যায়। এটি এমন একটি যন্ত্র যা অগণিত উপাত্ত ও তথ্য গ্রহণ করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিশ্লেষণ করে দ্রুত সিদ্ধান্ত দিতে পারে। মানুষ যেমনভাবে তার স্মৃতিতে তথ্য ধরে রাখে, তেমনি কম্পিউটারও তার স্মৃতি বা মেমরিতে তথ্য ধরে রাখে। কম্পিউটারে রয়েছে তিনটি সুস্পষ্ট অংশ ১. সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিট, ২. ইনপুট ও ৩. আউটপুট। কম্পিউটার যেসব তথ্য নিয়ে কাজ করে তাকে ডেটা বলে; আর যে ক্রমবিন্যাস পদ্ধতিতে কাজ করে তাকে বলে প্রােগ্রাম। কম্পিউটারের নির্ভুলভাবে কাজ করার পেছনে রয়েছে বিশেষ কিছু পদ্ধতি অত্যন্ত দ্রুত গণনা করার ক্ষমতা; বিপুল পরিমাণ উপাত্তকে স্মৃতিতে ধরে রাখার ক্ষমতা; তথ্য বিশ্লেষণের নির্ভুল ক্ষমতা; প্রােগ্রাম অনুসারে কাজ করার ক্ষমতা।

ইতিহাস বিবর্তন:

গণিতবিদ চার্লস ব্যাবেজ (১৭৯২-১৮৭১)-কে কম্পিউটার সৃষ্টির জনক বলা হয় । ১৮৩৩ সালে ব্যাবেজ ‘এনালিটিক্যাল ইঞ্জিন’ নামক গণনা যন্ত্র তৈরির পরিকল্পনা করেন। ব্যাবেজ যে পাঁচটি ভাগে (স্টোর, মিল, কন্ট্রোল, ইনপুট, আউটপুট) কম্পিউটার তৈরির পরিকল্পনা করেছিলেন তার ওপর ভিত্তি করেই ১৯৬৪ সালে ‘ইনিয়াক’ নামক প্রথম কম্পিউটার আবিষ্কৃত হয় । তবে বর্তমানকালে এগুলাে শুধুই ইতিহাস; বাজারে ষষ্ঠ প্রজন্মের কম্পিউটারের আগমন ঘটেছে আর সপ্তম প্রজন্মের কম্পিউটার আসার প্রতীক্ষায় রয়েছে। তবে সাধারণভাবে আমরা যেকোনাে ইলেকট্রিক জিনিসের যদি ce (Computer Electronics) লেখা দেখি তবে বুঝতে হবে সেটি কোনাে না কোনােভাবে কম্পিউটারের প্রভাবজাত।

বাংলাদেশে কম্পিউটার:

পূর্ব পাকিস্তানে (১৯৭১ পূর্ববর্তী বাংলাদেশ) ১৯৬৪ সালে আণবিক শক্তিকেন্দ্রে IBM 1620 সিরিজে একটি কম্পিউটার আনার মাধ্যমে এ দেশে কম্পিউটারের পদচারণা শুরু হয় । কিন্তু আশির দশকের আগে এ দেশে কম্পিউটার শিক্ষার কোনাে প্রসার হয়নি। নব্বইয়ের দশক থেকেই মূলত এদেশে কম্পিউটার শিক্ষা ও কম্পিউটার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা শুরু হয়। বর্তমানে আমাদের দেশে কম্পিউটার মানুষের প্রায় হাতে হাতে পৌছে গেছে। দেশেই তৈরি হচ্ছে নানা ধরনের সফটওয়্যার। দিন দিন বাংলাদেশের আইটি (ইনফরমেশন টেকনােলজি) কম্পিউটারকে ভিত্তি করে বিশ্বদরবারে শক্তিশালী জায়গা করে নিচ্ছে।

আধুনিক জীবন কম্পিউটার:

বর্তমান সময়ে কম্পিউটার আধুনিক মানুষের সবচেয়ে বড় বন্ধু। বহু বহু অঙ্কের হিসাব সহজেই কম্পিউটার করে দিতে পারে। সরকারি-বেসরকারি অফিস, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, বীমা প্রতিষ্ঠান সবস্থানেই। কাজের সুবিধার্থে কম্পিউটার ব্যবহার করা হয়। পরীক্ষার ফল থেকে শুরু করে অপরাধী শনাক্তকরণের সব কাজে কম্পিউটার ব্যবহার করা হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের নকশা তৈরি, বহুতল ভবনের ডিজাইন, শিশুদের অঙ্কন শিক্ষাসহ বিনােদনমূলক নানা। শিক্ষা, জটিল রােগ নির্ণয়া প্রভৃতি কাজে কম্পিউটারের সাফল্য ঈর্ষণীয়। মােটকথা, বর্তমানে জীবনের প্রায় সব কাজ কম্পিউটারের ওপর নির্ভরশীল।

কম্পিউটার বেকারত্ব:

বেকারত্ব নিরসনে কম্পিউটার অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। এদেশের বাস্তবতায় সবার পক্ষে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। সে কারণে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির পর অনেকেই কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিয়ে তাদের জীবনে বেকারত্বের অবসান করেছে। কেউ সফটওয়্যারের নানা ধরনের ট্রাবলশুটিং করছে, কেউ আবার হার্ডওয়্যারের সমস্যার সমাধান করছে। তাছাড়া প্রতিটি অফিসেই কম্পিউটার অপারেটর পদে জনবল নিয়ােগ দেয়া হচ্ছে যার প্রধানতম যােগ্যতা কম্পিউটার বিষয়ে দক্ষতা। কাজেই বলা যায় এদেশের বেকারত্ব নিরসনে কম্পিউটার আশীর্বাদ হয়েই দেখা দিয়েছে।

কম্পিউটার শিক্ষা:

বর্তমান সময়ের প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা সবস্থানেই কম্পিউটার বিষয়ে পড়ানাে হচ্ছে। প্রাথমিক ওমাধ্যমিক শিক্ষায় কম্পিউটার বিষয় হিসেবে যেমন পড়ানাে হচ্ছে, তেমনি উচ্চশিক্ষায় কম্পিউটার সায়েন্সে স্নাতক ডিগ্রি প্রদান করা হচ্ছে। তাছাড়া কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পড়ে দেশে কম্পিউটার বিষয়ের প্রকৌশলী সৃষ্টি হচ্ছে যারা বিভিন্ন পর্যায়ে কম্পিউটার বিষয়ে উচ্চতর দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে। দেশেই সৃষ্টি হচ্ছে নানা ধরনের কম্পিউটার ফার্ম যারা কম্পিউটারের মানােন্নয়ন ও এর ব্যবহারকে আরও প্রসারিত করার কাজে নিয়ােজিত রয়েছে।

কম্পিউটার শিল্পবাণিজ্য:

শিল্প ও বাণিজ্যে কম্পিউটার ব্যবহার বহু বহু কর্মঘণ্টা ও পরিশ্রমকে সাশ্রয় করেছে। অটোমেশনের ফলে ভারী ভারী অনেক কাজও সহজ হয়ে গেছে। বন্দরগুলােতে ডিজিটাল সিস্টেম ব্যবহার করা হচ্ছে, ফলে পণ্য খালাসেও নতুন গতি সঞ্চার হয়েছে। পােশাক কারখানা ও দেশীয় ইলেকট্রনিকস কারখানায় কম্পিউটার চালিত বড় বড় রােবট ব্যবহার করে কাজে নতুন গতি সঞ্চার করা হয়েছে। শিল্পের সমস্ত পর্যায়ে কম্পিউটার দিয়েছে নতুন গতি ও প্রাণ। বাংলাদেশে বর্তমানে শিল্প ও বাণিজ্যের কোনাে সেক্টরই কম্পিউটারের বাইরে নয়।

কম্পিউটার কৃষি:

বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর; তাই কৃষিতে কম্পিউটারের ব্যবহার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন আর পরীক্ষা ছাড়া কৃষক মাটিতে সার ও কীটনাশক দেয় না। জমির উর্বরতাও এখন কম্পিউটারের মাধ্যমে নির্ণয় করা হয়। তাছাড়া কম্পিউটারের সাহায্যে আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানা সম্ভব হয় বলেই কৃষক তার ফসলকে রক্ষা করার সুযােগ পায়। গবেষণাগারে কম্পিউটারের মাধ্যমে গবেষণা করেই নতুন নতুন উন্নত ফসলের জাত উদ্ভাবন করা সম্ভব হচ্ছে। আর সেগুলো মাটিতে বপন করেই কৃষক ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করছে। পরােক্ষভাবে কম্পিউটারের সাহায্য নিয়েই কৃষক তার ফসল বিদেশে রপ্তানি করছে।

উপসংহার:

তৃতীয় বিশ্বের মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে বাংলাদেশে আজ প্রযুক্তির বহুমুখী উৎকর্ষ সাধন খুবই জরুরি। আর সে কাজটি সম্ভব হতে পারে কম্পিউটার নামক যন্ত্রের সাহায্যে। কম্পিউটার এখনাে সব মানুষের কাছে সহজসাধ্য হয়নি। যেহেতু আমরা কম্পিউটারের প্রায় সকল যন্ত্রাংশই আমদানি করি, তাই এক্ষেত্রে সরকারের বিশেষ প্রণোদনা দেয়া আবশ্যক। তাছাড়া সম্ভব হলে কম্পিউটার ক্রয়-বিক্রয়ে সব রকম ভ্যাট প্রত্যাহার করা উচিত। যাতে মানুষ খুব সহজেই কম্পিউটারের সান্নিধ্যে আসতে পারে এবং তার জীবনকে উন্নত ও আধুনিক করে তুলতে পারে।

চিকিৎসাক্ষেত্রে বিজ্ঞান

বা চিকিৎসাক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অবদান রচনার সংকেত (Hints)

  • ভূমিকা
  • রোগ নিরূপণে চিকিৎসা বিজ্ঞান
  • উপসংহার

চিকিৎসাক্ষেত্রে বিজ্ঞান অবদান রচনা

ভূমিকা:

আধুনিক যুগ বিজ্ঞানের অব্যাহত অগ্রগতি ও জয়যাত্রার যুগ। এ জয়যাত্রায় চিকিৎসাক্ষেত্র পেয়েছে অভাবনীয় সাফল্য। একুশ শতকে রােগ নিরূপণ ও নিরাময়ে অর্থাৎ চিকিৎসাক্ষেত্রে বিজ্ঞানের সাফল্য বিস্ময়কর। বিভিন্ন ধরনের রােগের চিকিৎসায় নিত্যনতুন ওষুধ আবিষ্কারের ফলে বেড়েছে মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে মানুষের কর্মক্ষমতা । অথচ সুপ্রাচীনকালে মানুষ রােগব্যাধিকে স্রষ্টার অভিশাপ ও অশুভ আত্মার কুপ্রভাব বলে মনে করত। চিকিৎসাক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অভাবনীয় সাফল্যে মানুষ কুসংস্কারাচ্ছন্নতা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে। বিজ্ঞান মানুষকে করেছে আধুনিক মনস্ক।

রোগ নিরূপণে চিকিৎসা বিজ্ঞান:

চিকিৎসাক্ষেত্রে বিজ্ঞানের ব্যাপক সাফল্য এসেছে বিশ ও একুশ শতকে। সঠিকভাবে রােগ নিরূপণ, এমনকি জন্মপূর্ব রােগ নির্ণয়েও ঘটেছে বড় ধরনের উত্তরণ। রােগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে রক্ত পরীক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের রক্তে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের উপাদান। এর সঠিক ও নিয়ন্ত্রিত মাত্রা শরীরের সুস্থতার লক্ষণ । কিন্তু শরীর অসুস্থ হলে রক্তের উপাদানের মাত্রায় হেরফের ঘটে। রক্তের বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা করা যায় কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই। আর এর মাধ্যমেই রােগ নির্ণয় করা সম্ভব হয়। রক্তের সঙ্গে নানারকম রাসায়নিক যৌগ মিশিয়ে গবেষণাগারে এসব পরীক্ষা বিজ্ঞানেরই অবদান। রক্তের মতাে ক্ষেত্রবিশেষে মলমূত্রও পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। এইসব পরীক্ষায় ব্যবহৃত হয় বিভিন্ন ধরনের বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি। যেমন— গ্লুকোমিটার যন্ত্রের মাধ্যমে মূত্র পরীক্ষা করে ঘরে বসেই ডায়াবেটিক রােগীর শরীরে গ্লুকোজের মাত্রা নির্ণয় করা যায়। স্কিনমােম্যানােমিটার রক্তচাপ মাপার যন্ত্র। এর মাধ্যমে পালসবিট নির্ণয় করে বেরিয়ে যায় রক্তচাপের পরিমাপ। এক্সরে, আলট্রাসনােগ্রাফি, এন্ডােস্কোপি ইত্যাদির মাধ্যমে মানবদেহের অভ্যন্তরস্থ হাড়, ফুসফুস, বৃহদন্ত্র, পাকস্থলী, উদর, ক্ষুদ্রান্ত্র, শিরা, ধমনী ইত্যাদির অবস্থা অবলােকন করে নির্ভুলভাবে রােগ নির্ণয় করা যায়। ফাইবার অপটিক সংবলিত বিভিন্ন যন্ত্রের সাহায্যে ক্যান্সার নির্ণয়ও আজ আর জটিল কিছু নয়। সিটিস্ক্যান ও এম আর আই-এর মাধ্যমে নির্ণয় করা যায় মস্তিষ্কের যেকোনাে ধরনের রােগ— ব্রেইন টিউমার থেকে শুরু করে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র নানা সমস্যা। ইসিজি ও ইকো মেশিনের মাধ্যমে বেরিয়ে আসে হৃদযন্ত্রের সমস্যা। হৃদযন্ত্রের রক্তনালীর রােগ নির্ণয় করা যায় এনজিওগ্রাম করে। চোখের নানাবিধ সমস্যা যেমন- দূরের বা কাছের দৃষ্টিশক্তিজনিত রােগ নির্ণয়েও রয়েছে বিজ্ঞানের অবদান। আবিস্কৃত হয়েছে বিশেষ বিশেষ যন্ত্র, যার মাধ্যমে নির্ধারণ করা যায় চোখের সঠিক পাওয়ার, নির্ণয় করা যায় চোখের বিভিন্ন রকমের রােগ। চিকিৎসা বিজ্ঞানে লেজার রশ্মি ও কম্পিউটার প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে রােগ নির্ণয় হচ্ছে সর্বাধুনিক পদ্ধতিতে।

রোগ নিরাময়ে চিকিৎসা বিজ্ঞান:

যক্ষ্মা, পােলিও, টিটেনাস, হাম, ডিপথেরিয়া ও হুপিংকাশিসহ বিভিন্ন মারাত্মক রােগ থেকে শিশুদের রক্ষা করার জন্য টিকা আবিষ্কার বিজ্ঞানের এক বিস্ময়কর সাফল্য। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব ভাইরাস দ্বারা এসব রােগ সৃষ্টি হচ্ছে সেসব ভাইরাস দিয়েই তৈরি হচ্ছে সেসব রােগের প্রতিরােধক টিকা। রােগবীজনাশক রাসায়নিক পেনিসিলিন বিভিন্ন ধরনের রােগবীজ ও ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করে দিতে পারে । পেনিসিলিনের আবিষ্কার চিকিৎসা বিজ্ঞানে এনেছে ব্যাপক পরিবর্তন।

ভাঙা হাড় জোড়া লাগানাে, কৃত্রিম অঙ্গ সংযােজন, অস্থিমজ্জা, হৃদপিণ্ড, বৃক্ক, যকৃৎ, এমনকি ফুসফুসের মতাে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন সম্ভব হচ্ছে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে । প্লাস্টিক সার্জারির মাধ্যমে শরীরের বাহ্যিক পরিবর্তনও সম্ভব হচ্ছে বিজ্ঞানের আশীর্বাদে। ওপেন হার্ট সার্জারি, হার্টের বাইপাস সার্জারি, পেসমেকার স্থাপন করে কৃত্রিমভাবে হৃদ্যন্ত্র সচল রাখা— সবই চিকিৎসাক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অবদান। আলােক চন্দ্র বা অপটিক ফাইবার সংবলিত বিভিন্ন যন্ত্রের সাহায্যে ছােট টিউমার অপসারণ এবং রক্তবাহী নালিকা মেরামত করা যায় । মূত্রথলি ও পিত্তকোষের পাথর কাটাছেড়া ছাড়াই লেজার রশ্মি ও অতিকম্পনশীল শব্দের মাধ্যমে চর্ণ করা যায়। চোখ ও দাঁতের চিকিৎসায়ও ব্যবহৃত হচ্ছে লেজার রশ্মি । লেজার রশ্মির মাধ্যমে চোখের ছানি অপারেশন এখন স্বাভাবিক ঘটনা। কসমেটিক লেন্স আবিষ্কার, এখন চশমা ব্যবহারের বাড়তি ঝক্কি থেকেও মানুষকে রেহাই দিয়েছে। রুট ক্যানেলের মাধ্যমে প্রায় নষ্ট হয়ে যাওয়া দাঁতকে স্বাভাবিক করে তােলা, কৃত্রিম দাঁত মানুষকে দিচ্ছে স্বস্তি।

ক্যান্সার এখন আর দুরারােগ্য ব্যাধি নয় । চিকিৎসা বিজ্ঞানের আশীর্বাদে এ রােগে আক্রান্তদের সুস্থ হওয়ার হার বাড়ছে। ‘কেমাে থেরাপি’, ‘রেডিও থেরাপি’, ‘মেপ থেরাপি’ প্রভৃতি চিকিৎসার মাধ্যমে ক্যান্সার কোষকে নির্মূল করা সম্ভব হচ্ছে। সন্তানহীন মায়ের কোলে ছোট্ট শিশুর হাসি দেখিয়েছে বিজ্ঞান। ক্লোন বেবি’, ‘টেস্ট টিউব বেবি’ নিঃসন্দেহে বিজ্ঞানের বিস্ময়কর আবিষ্কার চিকিৎসাক্ষেত্রে বিজ্ঞানের আরেকটি বিস্ময় জীবনরক্ষাকারী যন্ত্র ভেন্টিলেটর । ভেন্টিলেটরের সাহায্যে মুমূর্ষ রােগীকে কৃত্রিমভাবে অক্সিজেন দেয়া হয়। কৃত্রিমভাবে হৃদযন্ত্র পাম্প করে হৃদস্পন্দন চালু রাখা হয়। ফলে কখনাে কখনাে প্রায় মৃত অর্থাৎ ‘কোমা পরিস্থিতি থেকে মানুষ জীবন ফিরে পায়।

শুধু যন্ত্রপাতি আর অস্ত্রোপচার নয়, রােগ নিরাময়ে ওষুধ আবিষ্কারও বিজ্ঞানের গবেষণারই ফল। ট্যাবলেট, ক্যাপসুল, সিরাপের পাশাপাশি নাপােজিটারি, ইনজেকশন, ইনহেলার, নেবুলাইজার ইত্যাদি বিজ্ঞানেরই গবেষণার ফল । ওষুধে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া, মেয়াদ, নিয়ন্ত্রিত মাত্রা, ব্যবহারবিধি ইত্যাদি নির্দেশাবলি থাকে।

উপসংহার:

চিকিৎসাক্ষেত্রে বিজ্ঞানের এ ধরনের অবদান মানুষের জীবনকে করেছে আনন্দময়, কর্মক্ষম । চিকিৎসায় বিজ্ঞানের নানা ধরনের আবিষ্কারের আগে কলেরা, বসন্ত, যক্ষ্মাসহ নানারকম রােগে অকালে অনেক মানুষ মারা যেত। উজাড় হয়ে যেত গ্রামের পর গ্রাম । আধুনিক যুগে বিজ্ঞানের কল্যাণক্রমে শুধু এগুলােই নয়, জটিল অনেক ব্যাধি জয় করেছে মানুষ। আর এসবের পেছনে রয়েছে বিজ্ঞানীদের নিরলস সাধনা ও গবেষণা।

পরিবেশ দূষণ তার প্রতিকার

  • ভূমিকা
  • পানিদূষণের উৎস
  • পানির দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব
  • পানিদূষণ প্রতিরােধে করণীয়
  • উপসংহার
  • পানিদূষণ ও এর প্রতিকার রচনা লিখন

ভূমিকা:

বিশ্বজুড়ে চার ভাগের তিন ভাগই পানি। আর পানির অপর নাম জীবন। তাই পানির অভাবের কারণে জীবন বিপন্ন হবার কথা নয়। কিন্তু জীবনের জন্য অত্যাবশ্যকীয় পানি যখন নানা কারণে দূষিত হয় তখন মানুষ বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়ে । বাস্তবে দিনের পর দিন তাই ঘটছে। পৃথিবীর মােট পানির শতকরা নিরানব্বই ভাগই ব্যবহারের অনুপযােগী হয়ে পড়েছে মারাত্মক পানিদূষণের কারণে ।

পানিদূষণের উৎস:

সুপ্রাচীনকাল থেকেই মানুষ পানি ব্যবহার করে আসছে ইচ্ছেমতাে। সে সময় পানিদূষণের মতাে পরিবেশগত বিপত্তি দেখা দেয়নি কখনাে। কেননা সংশােধিত পদ্ধতিতেই পানি ব্যবহার উপযােগী ও বিশুদ্ধ থাকত। কিন্তু আধুনিক সভ্যতা বিকাশের সাথে সাথে পানিদূষণের মাত্রা দিন দিন বেড়ে চলেছে। পানিদূষণ দু ভাবে হতে পারে। প্রথমত, প্রাকৃতিক উপায়ে; দ্বিতীয়ত, মানুষের মাধ্যমে । এ দুটোর মধ্যে মানুষই পানিদূষণের জন্য বেশি দায়ী । বাংলাদেশে পানিদূষণ: বাংলাদেশে পানিদূষণ মারাত্মক পর্যায়ে পৌছেছে। যেসব ক্ষেত্র থেকে এ দূষণ ঘটছে তার মধ্যে প্রধান হলাে:

১. টিউবওয়েলের পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা গ্রহণযােগ্য পরিমাণের চেয়ে বেশি হওয়ায় কোটি কোটি মানুষ আর্সেনিকজনিত রােগে আক্রান্ত হয়।

২. শিল্পোৎপাদন কেন্দ্র, কলকারখানা ইত্যাদি থেকে নির্গত বিষাক্ত বর্জ্যের বিষক্রিয়ায় পানি দূষিত হয়।

৩, বাংলাদেশের ট্যানারি শিল্পকারখানার শতকরা ৯০ ভাগই রাজধানী ঢাকার জনবহল হাজারিবাগ এলাকায়।

  1. এসব ট্যানারি থেকে নির্গত তরল ও কঠিন বর্জ্যে বুড়িগঙ্গা নদীর মাছ, জলজ জীব ইত্যাদি বিলীন হতে চলেছে। বিষাক্ত গন্ধ ও গ্যাস বাতাসে ছড়িয়ে এলাকাবাসীর স্বাস্থ্যের জন্যও হুমকি হয়ে দাড়িয়েছে। অপরিকল্পিত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার কারণে জলাশয়গুলােতে ছড়িয়ে পড়ছে মালবাহিত জীবাণু।

৫. শিল্পবর্জ্য ছাড়াও শহরের ময়লা, হােটেল-রেস্তোরা ও বাসাবাড়ির আবর্জনা পানিতে মিশে পানিদূষণ ঘটাচ্ছে।

৬. কৃষিক্ষেত্রে কীটনাশক ও রাসায়নিকের ব্যবহার পানিদূষণের অন্যতম প্রধান কারণ। কৃষিক্ষেত্র থেকে বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে কীটনাশকের বিষ পুকুর, নদী প্রভৃতি জলাশয়ে গিয়ে পড়ে এবং পানিদূষণ ঘটে।

৭. জলাশয়গুলাের পানিদূষণের ফলে দেশের বড় বড় শহরগুলােতে ওয়াসার পানিতে ক্ষতিকর রােগজীবাণুর উপস্থিতি আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে।

পানির দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব:

এভাবে নানা উপায়ে পানিদূষণ পরিবেশ, স্বাস্থ্য ও জীবনের জন্য মারাত্মক হুমকির সৃষ্টি করছে। আর্সেনিক বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তি চামড়ার ক্যান্সারসহ নানা রােগে আক্রান্ত হচ্ছে। অনেকে পঙ্গু হয়ে পড়ছে। এমনকি মৃত্যুর মতাে ঘটনাও ঘটছে। পানির ক্ষতিকর জীবাণু টাইফয়েড, ডায়রিয়া, জন্ডিস, কৃমি, আমাশয় ইত্যাদি রােগের জন্য দায়ী। দূষিত পানির প্রভাবে লক্ষ লক্ষ টাকার মাছ মরে যাচ্ছে, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জলজ প্রাণী এ ধরনের পানি ব্যবহারের ফলে গ্রামের সাধারণ মানুষ বিভিন্ন ধরনের চর্মরােগ ও পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। অন্যদিকে, জমির কীটনাশক পানিতে মিশে যাওয়ায় মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর শরীরে প্রবেশ করছে এবং পর্যায়ক্রমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঘটাচ্ছে। পরােক্ষভাবে এ ধরনের রাসায়নিক গ্রহণের ফলে মানবদেহে এর প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে। ক্যান্সার, পক্ষাঘাত, লিভার ও কিডনির সমস্যা, পেটের পীড়া প্রভৃতি রােগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। উন্নয়নশীল বিশ্বে প্রতিবছর অসংখ্য মানুষ মারা যাচ্ছে। এমন সব রােগে যার সাথে প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ সম্পর্ক রয়েছে পানিদূষণের।

পানিদূষণ প্রতিরােধে করণীয়:

পানিদূষণের ফলে সুপেয় পানির সংকট দেখা দেয়। ব্যবহারের ক্ষেত্রেও পানি অনুপযােগী হয়ে পড়ে। এ সংকট নিরসনে পানিদূষণের উৎস ও কারণগুলাে চিহ্নিত করে পানিদূষণমুক্ত করার জন্য প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। বেশ কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্বব্যাংকের মধ্যে আর্সেনিকমুক্ত পানি সরবরাহ প্রকল্প চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী ভূগর্ভস্থ পানি আর্সেনিক মুক্ত করা, বিকল্প পানি সরবরাহ প্রভৃতি বিষয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি পানিদূষণ প্রতিরােধে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার— প্রথমত, শিল্পকারখানার বিষাক্ত বর্জ্য অপসারণে বিকল্প ব্যবস্থা নেয়া। দ্বিতীয়ত, শহরের ট্যানারিগুলাের বর্জ্য শােধনব্যবস্থা । প্রয়ােজনে ট্যানারিগুলােকে শহরের বাইরে স্থানান্তর । তৃতীয়ত, ক্ষতিকর বিষাক্ত কীটনাশক ব্যবহার থেকে বিরত থাকা।চতুর্থত, উন্নত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। পঞমত, পানিকে দূষণমুক্ত রাখতে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি।

উপসংহার:

পানি সম্পদের প্রাচুর্যে বাংলাদেশ সমৃদ্ধ। এখানে ভূগর্ভস্থ পানি যেমন রয়েছে তেমনি ভূপৃষ্ঠের পানিও প্রচুর। সেই সাথে রয়েছে কৃষি, শিল্প ও গৃহস্থালি কাজে পানির ব্যাপক চাহিদা। কিন্তু ভয়ানক পানিদূষণ যেভাবে মানুষের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে, পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে তাতে সকল মহল সচেতন না হলে এবং প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ না নিলে ভয়াবহ বিপর্যয় দেখা দেবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, পানির অপর নাম মরণ নয়, পানির অপর নাম জীবন।

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ এর প্রতিকার

  • ভূমিকা
  • প্রাকৃতিক দুর্যোগের ধরন
  • ঝড়
  • ঘূর্ণিঝড়
  • টর্নেডাে
  • কালবৈশাখি
  • বন্যা
  • নদীভাঙন
  • ভূমিধস
  • ভূমিকম্প
  • আর্সেনিক
  • বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রতিকার
  • উপসংহার

ভূমিকা:

মানবসৃষ্ট নয় এমন দুর্ঘটনা, যা মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে তাই-ই প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এর বিস্তার অবশ্য পৃথিবীর সব দেশে সমান নয়। উন্নত দেশগুলাের তুলনায় উন্নয়নশীল দেশগুলােতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকির মাত্রা বেশি। বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের এক দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এসব দুর্যোগে প্রাণহানি ও সম্পত্রে ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে ব্যাপক। ঝড়, বন্যা, খরা, জলােচ্ছ্বাসের মতাে ভয়াবহ দুর্যোগ মানুষের সযত্নে লালিত সংসার নিমেষে নিঃশেষ করে দেয় । অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দোলাচলে পড়ে অসহায় মানুষ।

প্রাকৃতিক দুর্যোগের ধরন:

ভৌগােলিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগসমূহকে প্রধান তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। এগুলাে হলাে—

১. বায়ুমণ্ডলে সংঘটিত দুর্যোগ— এর মধ্যে পড়ে কালবৈশাখি, ঝড়, ঘূর্ণিঝড়, হারিকেন, টর্নেডাে, খরা, অতিবৃষ্টি ইত্যাদি।

২. ভূপৃষ্ঠে সৃষ্ট দুর্যোগ যেমন— বন্যা, ভূমিধস, নদীভাঙন, ভূ-অভ্যন্তরস্থ পানিদূষণ প্রভৃতি। ৩.ভূগর্ভস্থ দুর্যোগ ভূ-অভ্যন্তরে সৃষ্ট দুর্যোগের মধ্যে প্রধান হলাে ভূমিকম্প ও অগ্ন্যুৎপাত । এসব দুর্যোগের মধ্যে ঝড়ঝঞা,নদীভাঙন, খরা, ভূমিধস, ভূগর্ভস্থ পানিদূষণ ইত্যাদিতে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় বেশি। অগ্ন্যুৎপাতের সম্ভাবনা না থাকলেও ভূমিকম্পের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশে সংঘটিত প্রধান প্রধান প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলাে হলাে:

ঝড়: তীব্র বাতাস ও বজ-বিদ্যুৎসহ ভারী বৃষ্টিপাত ঝড়ের সাধারণ চিত্র। এ সময় সমুদ্র থাকে উত্তল ।

ঘূর্ণিঝড়:

ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের তীব্রতা অনেক বেশি হয় কখনাে কখনাে তা ঘণ্টায় ২৫০ কিলােমিটার বেগে বয়ে যায়। সমুদ্রে সৃষ্টি হয় জলােচ্ছ্বাসের। প্রতিবছরই এপ্রিল-মে এবং অক্টোবর-নভেম্বরে বাংলাদেশে ছােট-বড় ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। প্রবল শক্তিসম্পন্ন এ ঝড়ে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয় চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নােয়াখালী, খুলনা, বরিশাল ও পটুয়াখালীর উপকূলীয় অঞ্চল এবং সমুদ্র তীরবর্তী দ্বীপসমূহ। ১৯৭০ সালে মেঘনা মােহনায় প্রবল ঘূর্ণিঝড় ও জলােচ্ছাসে প্রায় তিন লক্ষ মানুষ প্রাণ হারায়, গবাদিপশু ও ফসলেরও ক্ষতি হয় প্রচুর। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড় ও জলােচ্ছাসে দেড় লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়, সম্পদহানি হয় ছয় শ কোটি টাকার। ২০০৭ সালে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে আঘাত হানে প্রচণ্ড শক্তিসম্পন্ন ঘূর্ণিঝড় সিডর’। এতেও জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। বিশ্বের একমাত্র ম্যানগ্রোভ বন সুবন’ ক্ষতিগ্রস্ত হয় সবচেয়ে বেশি।

টর্নেডো:

বাংলাদেশে টর্নেডাে আঘাত হানে সাধারণত এপ্রিল মাসে, যখন তাপমাত্রা সর্বোচ্চ থাকে। এটি স্বল্পকালীন দুর্যোগ, আঘাতও হানে স্বল্প এলাকা জুড়ে। কিন্তু যেখানে আঘাত হানে মাত্র দশ-বিশ মিনিটের মধ্যেই ওই এলাকা সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়ে যায়। টর্নেডাে আঘাত হানে ঢাকা জেলার বিভিন্ন অঞ্চল— গাজীপুর, টাঙ্গাইল, পাবনা, ফরিদপুর, রাজবাড়ি গােপালগঞ্জ প্রভৃতি জেলায়।

কালবৈশাখি:

কালবৈশাখি সাধারণত এপ্রিল-মে মৌসুমে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে যায়। এর গতিবেগ সাধারণত চল্লিশ থেকে ষাট কিলােমিটার হয়ে থাকে। ব্যাপ্তিকালও স্বল্প, কখনাে কখনাে এক ঘণ্টা স্থায়ী হয়। কালবৈশাখি সাধারণত আঘাত হানে শেষ বিকেলের দিকে। মাঝে মাঝে এ ঝড়ের সাথে শিলাবৃষ্টিও হয়

বন্যা:

প্রতিবছর বাংলাদেশের এক বিস্তৃর্ণ ভূভাগ বন্যায় প্লাবিত হয়। ঋতুগত কারণে, নদনদীর পানি বেড়ে যাবার ফলে প্রবল। বৃষ্টিপাতের ফলে পাহাড়ি ঢল নেমে, নদীর বাঁধ ভেঙে জলােচ্ছাস ও জোয়ারের ফলে বাংলাদেশে বন্যা দেখা দেয়। বন্যায় প্রাণহানি কম হলেও সম্পদ ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। অনেক গবাদিপশু মারা যায়। বন্যাপরবর্তী সময়ে খাদ্যাভাব এবং নানারকম রােগব্যাধি দেখা দেয়। গৃহহীন হয়ে পড়ে অনেক লােক। বাংলাদেশে ১৯৫৫, ১৯৭৪, ১৯৮৭, ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০৪ ও ২০০৭ সালে সৃষ্ট বন্যায় প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল । ১৯৭৪ সালে বন্যার পরপরই দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় এবং তাতে প্রায় ত্রিশ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালের বন্যায় মৃতের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যায় ।

নদীভাঙন:

বাংলাদেশে প্রতিবছর নদীভাঙনের ফলে বসতভিটা, ফসলি জমি নদীর বুকে বিলীন হয়ে যায়। লক্ষ লক্ষ লােক নদীভাঙনের কবলে পড়ে সহায়সম্বলহীন হয়ে গ্রাম থেকে শহরে আশ্রয় নেয়।

ভূমিধস:

ভূমিধস পাহাড়ি এলাকায় সংঘটিত হয়। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি প্রভৃতি পাহাড়ি অঞ্চলে বর্ষা মৌসুমে মাঝে মাঝে পাহাড় ধসে পড়ে। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা অনেক ঘরবাড়ি চাপা পড়ে, ঘটে প্রাণহানি। নির্বিচারে ও অনিয়মতান্ত্রিকভাবে পাহাড় কাটার কারণেও ভূমিধস হয়। ভূমিধসের কারণে পাহাড়ি এলাকায় সড়ক যােগাযোেগও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

ভূমিকম্প:

ভূমিকম্প একটি ভয়াবহ ও মারাত্মক প্রাকৃতিক বিপর্যয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে রয়েছে। বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চল ও আসাম এলাকায় ১৮৯৭ সালে ৮.৭ মাত্রার ভূমিকম্পে প্রায় দেড় হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, এ ধরনের ভূকম্পন একই এলাকায় একশ থেকে একশ ত্রিশ বছর পর আবার আঘাত হানতে পারে। এছাড়া প্রতি বছরই চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, মহেশখালী, সিলেট, ঢাকা, ময়মনসিংহ, রাজশাহী প্রভৃতি এলাকায় এক বা একাধিক মৃদু ভূমিকম্প অনুভূত হয়।

আর্সেনিক:

ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের উপস্থিতিতে বাংলাদেশের মানুষের স্বাস্থ্য বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়েছে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল বিশেষ করে কুষ্টিয়া, যশাের, ফরিদপুর, চাঁদপুর, নােয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও নারায়ণগঞ্জ জেলার অধিবাসীরা ভয়াবহ আর্সেনিক দূষণের শিকার।

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রতিকার:

প্রাকৃতিক দুর্যোগ সম্পূর্ণভাবেই প্রাকৃতিক। এ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া সম্ভব নয়। তবে গণসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে এবং পরিকল্পতভাবে দুর্যোগ মােকাবিলা করে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমানাে যায়। যেমন-

১. জলােচ্ছ্বাস ও বন্যা সমস্যা মােকাবিলার জন্য উপকূলীয় অঞলে প্রচুর পরিমাণে বনায়ন ও নদীর পানি বহন ক্ষমতা বাড়ানাের জন্য নদী খনন করা যেতে পারে।

২. ঘূর্ণিঝড় ও জলােচ্ছাস মােকাবিলায় আবহাওয়া পূর্বাভাসের মাধ্যমে জনগণকে সতর্ক করতে হবে। উপকূলীয় অঞ্চল থেকে দুত লােকজনকে সরিয়ে নিতে হবে নিরাপদ স্থানে। প্রয়ােজনে আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়াতে হবে।

৩. ভূমিকম্প হলে তাৎক্ষণিকভাবে কোথায় আশ্রয় নিতে হবে সে সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করতে হবে। ধ্বংসযজ্ঞ হলে।দুত উদ্ধার তৎপরতা চালানাের জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লােকবল ও আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা করতে হবে ।

উপসংহার:

যেকোনাে ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ সাময়িকভাবে স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে স্তব্ধ করে দেয় । অর্থনীতি হয়। নানাভাবে বিপর্যস্ত। ভূপ্রাকৃতিক বিন্যাস অনুযায়ী বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চল। তাই সব ধরনের দুর্যোগ মােকাবিলার জন্য সরকারিভাবে বাস্তবসম্মত ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। বেসরকারি উদ্যোগকেও দিতে হবে। প্রয়ােজনীয় পৃষ্ঠপােষকতা। স্থানীয় পর্যায়ে গড়ে তুলতে হবে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান। যেহেতু প্রাকৃতিক দুর্যোগ একটি জাতীয় দুর্যোগ। তাই দেশ ও দশের স্বার্থে দুর্যোগ মােকাবিলায় সকলকে দৃঢ়চিত্তে সমানভাবে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই দুর্যোগ পরবর্তী সমস্যা মােকাবিলা ও ক্ষয়ক্ষতি এড়ানাে সম্ভব।

মাদকাসক্তি এর প্রতিকার

  • ভূমিকা
  • মাদকের আদি উৎস
  • মাদকদ্রব্যের প্রকারভেদ
  • মাদক চোরাচালান
  • মাদকদ্রব্যের ব্যবহার
  • মাদকাসক্তির কারণ
  • বাংলাদেশে মাদকের আগ্রাসন
  • মাদকাসক্তির ভয়াবহতা
  • মাদকাসক্তির প্রতিকার
  • উপসংহার

ভূমিকা:

মাদকাসক্তি আমাদের সমাজের ভয়াবহ একটি সমস্যা। অবশ্য সমস্যা না বলে একে সংকট বলাই শ্রেয়; কারণ কিছু কিছু পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে একজন মানুষ নিজেকে মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলে। আমাদের দেশের তরুণদের মধ্যে মাদক গ্রহণের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। তবে এর ব্যতিক্রমও লক্ষ করা যায়। একটি জাতির উন্নয়নের ধারাকে গতিশীল করে তরুণ সমাজ। কিন্তু মাদক তরুণসমাজের সেই অদম্য কর্মপ্রেরণাকে ধ্বংস করে দেয়। ফলে সে নিজেকে যেমন ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়, তেমনি দেশকেও মহাবিপর্যয়ের মধ্যে ঠেলে দেয়। এই তরুণরাই তখন হয়ে ওঠে দেশের সবচেয়ে বিপথগামী সম্প্রদায়।

মাদকের আদি উৎস:

মাদক ও এর নেশার ইতিহাস বেশ প্রাচীন হলেও তার একটা সীমারেখা ছিল । মদ, গাঁজা, আফিম, চরস বা তামাকের কথা বহু আগে থেকেই মানবসমাজে প্রচলিত ছিল। উনিশ শতকের মধ্যভাগে বেদনানাশক ওষুধ হিসেবে মাদকের ব্যবহার শুরু হয় যাকে ইংরেজিতে ড্রাগ বলা হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে সৈনিকদের ব্যথার উপশম হিসেবে ড্রাগের ব্যবহার হলেও হতাশা কাটাতেও তারা ড্রাগ ব্যবহার করত। এরপর থেকেই কলম্বিয়া, বলিভিয়া, ব্রাজিল, ইকুয়েডর ইত্যাদি দেশে নেশার দ্রব্য হিসেবে ব্যাপকভাবে ড্রাগের ব্যবহার শুরু হয় এবং ধীরে ধীরে তা সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

মাদকদ্রব্যের প্রকারভেদ:

বর্তমান বিশ্বের প্রায় সব দেশেই মাদকদ্রব্য পাওয়া যায়। প্রাচীনকালের মাদকদ্রব্যের পাশাপাশি আধুনিক সময়ে নানা ধরনের মাদকদ্রব্যের উদ্ভাবন ও ব্যবহার লক্ষ করা গেছে । হেরােইন, প্যাথেড্রিন, এলএসডি, মারিজুয়ানা, কোকেন, হাসিস, প্রভৃতি আধুনিককালের মাদকদ্রব্য; তবে এর মধ্যে হেরােইন ও কোকেন বেশ দামি। আমাদের দেশের যুবসমাজ সচরাচর যে মাদকদ্রব্যগুলাে ব্যবহার করে সেগুলাে হলাে— সিডাকসিন, ইনােকটিন, প্যাথেড্রিন, ফেনসিডিল,ডেক্সপােটেন, গাঁজা ইত্যাদি। তবে এ সবকিছুর ব্যবহারকে ছাড়িয়ে গেছে অত্যাধুনিক এক মাদক— ইয়াবা’ যার নাম ।

মাদক চোরাচালান:

দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নানাভাবে মাদক চোরাচালান হয়। সীমান্তে স্থল বা জলপথে এবং আকাশ পথে বিশ্বব্যাপী এক বৃহৎ চোরাচালান নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে যার পেছনে রয়েছে বিরাট এক সিন্ডিকেট। কিছুকাল আগেও মায়ানমার, থাইল্যান্ড ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম নিয়ে গড়ে উঠেছিল আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালানের স্বর্ণভূমি’ বা ‘গােল্ডেন ট্রায়াঙ্গাল’ । তবে ভিয়েতনামে সমাজতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে এই নেটওয়ার্ক ভেঙে যায়। এর কিছুদিন পরেই চোরাচালানকারীরা ইরান, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান নিয়ে গড়ে তােলে ড্রাগ পাচারের নতুন ভিত্তিভূমি ‘গােল্ডন ক্রিসেন্ট’।

মাদকদ্রব্যের ব্যবহার:

মানুষ নিজেকে অপ্রকৃতিস্থ করতে মাদকদ্রব্য ব্যবহার করে। মাদকের ব্যবহার করে সে কল্পনার এক জগতে কিছুসময়ের জন্য বিচরণ করে। এক্ষেত্রে মাদক ব্যবহারকারীরা নানা ধরনের পদ্ধতি অনুসরণ করে যেমন— ধূমপান, ইনহেল বা শ্বাসের মাধ্যমে, জিহ্বার নিচে গ্রহণের মাধ্যমে, সরাসরি সেবনের মাধ্যমে, স্কিন পপিং ও মেইন লাইনিং-এর মাধ্যমে। তবে যেভাবেই গ্রহণ করুক না কেন তাদের উদ্দেশ্য একটাই— নেশায় উন্মত্ত হওয়া। প্রথমে কৌতূহলের বশে অনেকেই নেশাদ্রব্য গ্রহণ করে। কিন্তু আস্তে আস্তে তাতে অভ্যস্থ হয়ে ভয়াবহ এক সর্বনাশের পথে এগিয়ে যায়।

মাদকাসক্তির কারণ:

মাদকাসক্তির অন্যতম কারণ ব্যক্তিজীবনের হতাশা । মানুষ যখন জীবন সম্পর্কে অনেক বেশি হতাশ হয়ে

পড়ে, তখন সে মাদকদ্রব্যের আশ্রয় নেয় । হতাশা সাধারণ তরুণদের মধ্যেই বেশি দেখা যায়, তাই তাদের মাদক গ্রহণের হারও অনেক বেশি। তাছাড়া অসৎসঙ্গে লিপ্ত হয়েও অনেকেই মাদকের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। যেসব পরিবারে পারিবারিক অশান্তি অনেক বেশি সে পরিবারের ছেলেমেয়েদের জীবন বিশৃঙ্খল হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তারা এই বিশৃঙ্খলা থেকে ধীরে ধীরে মাদকের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং পরিণামে অনেক ভয়াবহ ঘটনা ঘটায়। আমরা প্রতিদিনের পত্রপত্রিকায় এ ধরনের দেখা যায়।

বাংলাদেশে মাদকের আগ্রাসন:

আমাদের দেশে মাদকের ব্যবহার আশঙ্কাজনকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। অবৈধভাবে দেশে প্রবেশ করা এই মাদক আমাদের যুবসমাজকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে। মায়ানমার থেকে অবাধে এ দেশে প্রবেশ করছে ইয়াবা, যাতে আক্রান্ত হয়েছে বহু তরুণ-তরুণী ও যুবক-যুবতী। দর্শনার ‘কেরু এন্ড কোম্পানি এদেশের একমাত্র লাইসেন্সধারী মন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কিন্তু তার বাইরে বহু বিদেশি কোম্পানির মদ অবৈধভাবে অবাধে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া গাঁজা ও আফিমের মতাে মাদকদ্রব্য প্রায় উন্মুক্তভাবে দেশের সর্বত্রই বিক্রি হচ্ছে এবং মাদকসেবীরা তা অবাধে ক্রয়ও করছে।

মাদকাসক্তির ভয়াবহতা:

মাদকের রূপ অত্যন্ত ভয়াবহ ও আগ্রাসী। একে অনেকটা অপ্রতিরােধ্য রােগ এইডস-এর সঙ্গে তুলনা। করা যেতে পারে। এইডস আক্রান্ত ব্যক্তির মতােই মাদকাসক্তি মানুষকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে নিয়ে যায়। ইয়াবা ও হেরােইনের মতাে মাদকদ্রব্য মানুষের শরীরের সমস্ত রােগ প্রতিরােধ ক্ষমতা ধীরে ধীরে নষ্ট করে দেয়। এর আসক্তিতে মানুষ এক অস্বাভাবিক জীবনযাপন করে। নেশায় আক্রান্ত ব্যক্তির সুস্থজীবনে ফিরে আসাও খুব সহজ হয় না। মাদক বন্ধ করা মাত্রই উইথড্রয়াল সিমটম’ শুরু হয়। তখন মাদক না পেলে শুরু হয় টার্কি পিরিয়ড’; হাত পা কাঁপতে থাকে; অসম্ভব শারীরিক যন্ত্রণা শুরু হয় এবং একপর্যায়ে তা হৃদপিণ্ডে আঘাত করে। এই সময় সুচিকিৎসা না পেলে খুব অল্প সময়ে মাদকাসক্ত ব্যক্তির মৃত্যু হতে পারে।

মাদকাসক্তির প্রতিকার:

পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রিক সচেতনার মাধ্যমে একজন মানুষকে মাদকদ্রব্য গ্রহণ থেকে বিরত

রাখা সম্ভব। পারিবারিকভাবে একজন নারী বা পুরুষের জীবন যদি সুস্থভাবে বেড়ে ওঠে তাহলে তার মাদকের সংস্পর্শে যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলাের এ ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। গণমাধ্যমের সাহায্য নিয়ে তারা নানাভাবে মাদকদ্রব্যবিরােধী প্রচারণা চালাতে পারে। রাষ্ট্রীয়ভাবে মাদকদ্রব্য বিক্রি ও এর সঙ্গে নিয়ােজিত চোরাকারবারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। সার্বিকভাবে একজন মানুষকে যদি তার নিকটাত্মীয়রা খুব ভালােভাবে পরিচর্যা করে এবং রাষ্ট্র যদি তাকে সুস্থভাবে বাঁচার পরিবেশ করে দেয় তবে খুব সহজেই মাদকাসক্তির প্রতিকার করা সম্ভব।

উপসংহার:

একটি দেশের গতিশীলতাকে অব্যাহত রাখে তরুণসমাজ। তারাই যদি মাদকের কবলে পড়ে নিজেদের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয় তবে দেশের সার্বিক অগ্রগতি চরমভাবে বিনষ্ট হবে। তাই তরুণসমাজকে মাদক সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং এর কারবারীদের সর্বার্থে বয়কট করতে হবে। তাদের ঐক্য ও সুস্থজীবনের শপথ গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ। মাদকমুক্ত হয়ে সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত হবে।

নারী শিক্ষার গুরুত্ব

  • ভূমিকা
  • নারীশিক্ষার অতীত ও বর্তমান
  • নারীশিক্ষার প্রয়ােজনীয়তা
  • নারীশিক্ষা সম্পর্কে গৃহীত পদক্ষেপ
  • নারীশিক্ষা বিস্তারে করণীয় বিষয়
  • উপসংহার
  • নারীশিক্ষা রচনা

ভূমিকা:

মানুষের মনুষ্যত্ব বিকাশে শিক্ষার কোনাে বিকল্প নেই। নারী’ হােক বা ‘পুরুষ’ হােক তাদের বড় পরিচয় হলাে তারা মানুষ। নারীদের মনুষ্যত্ব বিকাশের জন্য, উৎকৃষ্ট মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য শিক্ষার প্রয়ােজন অনস্বীকার্য। একটি আদর্শ জাতির জন্য আদর্শ মা প্রয়ােজন, চিরন্তন এ সত্যকে অস্বীকার করলে চলবে না। মা যদি শিক্ষিত না হয়, তাহলে সন্তান শিক্ষিত হবে না। সন্তান শিক্ষিত না হলে স্বাভাবিকভাবেই জাতির ভবিষ্যৎ হয় অন্ধকার। নারীশিক্ষার প্রসার নিশ্চিত করা সম্ভব হলে জাতীয় অগ্রগতি নিশ্চিত হবে। সভ্যতার চরম উৎকর্ষের বহুমাত্রিক সুযােগ-সুবিধার চূড়ান্ত ব্যবহার করতে নারীশিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম।

নারীশিক্ষার অতীত বর্তমান:

নারীশিক্ষার অতীত খুব সুখকর নয়। নানারকম সমস্যা অতীতে নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে বাধাবিঘ্নের সৃষ্টি করেছে। ব্রিটিশ শাসিত অবিভক্ত ভারতে উনিশ শতকের আগে নারীশিক্ষা ছিল অবহেলিত বিষয়। তারও আগে থেকেই অবশ্য এ অবহেলার শিকড় প্রােথিত হয়। নারীরা শিক্ষার আলাে থেকে বঞ্চিত ছিল। মূলত নিম্নলিখিত কারণে

ক. ধর্মীয় অনুশাসন,

খ. কুসংস্কার;

গ. পুরুষশাসিত সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি;

ঘ, নারীদের অজ্ঞতা, ধর্মীয় ভীতি;

ঙ. সাংস্কৃতিক চেতনার অভাব;

চ. শিক্ষা সম্পর্কে নারীদের উদাসীনতা;

ছ. পরনির্ভরশীলতা।

উপযুক্ত কারণগুলাে পাকিস্তান আমলেও আমাদের দেশে বিরাজমান ছিল। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে নারীশিক্ষার প্রসারে নানা উদ্যোগ গৃহীত হয় বর্তমান সময়ে নারীশিক্ষা আগের মতাে দুর্দশাগ্রস্ত না হলেও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি। এখনও আমাদের দেশে নারীরা পুরুষের সঙ্গে সমান হারে শিক্ষালাভ করতে পারছে না।

নারীশিক্ষার প্রয়ােজনীয়তা:

নােবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন নারীশিক্ষার প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে এক সেমিনারে বলেছেন, নারীশিক্ষা একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের প্রধান উপকরণসমূত্রে একটি।’ নেপােলিয়ান বলেছেন,

‘Let France have good

mothers and she will have good sons’,

নারীশিক্ষার প্রয়ােজন যুগ যুগ ধরেই ছিল। বর্তমান সভ্যতার আলােকে নারীশিক্ষা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হচ্ছে। দেশের সামাজিক, রাষ্টীয়, পারিবারিক এমনকি ব্যক্তিগত উৎকর্যের সঙ্গে নারী শিক্ষার গুরুত্ব জড়িয়ে পড়েছে। আমাদের দেশের লােকসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী। এ অর্ধেক জনগােষ্ঠী যদি শিক্ষা গ্রহণ না করে, মনুষ্যত্নের গুণাবলি অর্জন না করে তাহলে দেশের ভবিষ্যৎ যে অন্ধকার তা অনস্বীকার্য। পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সবক্ষেত্রেই শিক্ষিত নারীর প্রয়ােজন। শিক্ষিত নারী তার সতীর্থ পুরুষকে নিজের শিক্ষাদীক্ষার মাধ্যমে সহায়তা প্রদান করে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে। দেশের জন্য একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ভিত্তি তৈরিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে।

১.নারীশিক্ষার আদর্শ পরিবার প্রত্যাশিতভাবে গড়ে উঠতে পারছে না;

২.শিক্ষিত জনগােষ্ঠী গড়ে তােলার ক্ষেত্রে সমাজ বহুলাংশে পিছিয়ে থাকছে;

৩.অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা কাটছে না;

৪.দাম্পত্য বােঝাপড়া স্বচ্ছ হচ্ছে না;

৫.অশিক্ষিত নারী কর্মহীন বিবেচনায় দেশের বােঝা হয়ে আছে:

৬.নারীদের প্রকৃতিপ্রদত্ত গুণাগুণ বিকশিত হচ্ছে না;

৭.সামাজিক অনাচার ও পারিবারিক কলহ বাড়ছে;

৮.নারী তার নিজের অধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হতে পারছে না।

উপযুক্ত পরিস্থিতি আমাদের দেশে নারীশিক্ষার প্রয়ােজনীয়তাকে তীব্র করে তুলেছে। নারীশিক্ষার অনগ্রসরতার কারণে দেশের সমাজব্যবস্থায় বিরূপ প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।

নারীশিক্ষা সম্পর্কে গৃহীত পদক্ষেপ:

নারীশিক্ষা বিস্তারে স্বাধীনতা পরবর্তী সরকারগুলাে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। অবশ্য পদক্ষেপগুলাে বাস্তবায়ন হয়েছে খুবই যৎসামান্য। বর্তমানে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত নারীদের অবৈতনিক শিক্ষার সুযােগ করে দিয়েছে সরকার। তাছাড়া বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা বা এনজিও নিজেদের উদ্যোগে নারীশিক্ষা বিস্তারে বহুমুখী কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে যা খুবই আশাব্যঞ্জক। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও কাজ করছে । নারীর ক্ষমতায়ন ব্যবহারিক পর্যায়ে দ্রুত বিস্তার লাভ করেছে নারীশিক্ষার চলমান কর্মতৎপরতা থেকেই। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নারীদের আলাদা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও। গৃহীত এসব ব্যবস্থা নারীর সংখ্যার তুলনায় অপ্রতুল। তবু একটি প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে নারীশিক্ষার যে অগ্রগতি হচ্ছে তার গন্তব্য নিশ্চয়ই অনেক দূর।

নারীশিক্ষা বিস্তারে করণীয় বিষয়:

নারীশিক্ষা বিস্তারে সরকার কর্তৃক আরও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। বেসরকারি পর্যায়েও আরও বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত। সবার সমন্বিত উদ্যোগই কেবল নারীশিক্ষায় সফলতা এনে দিতে পারে।নারীশিক্ষা বিস্তারের জন্য নিম্নোক্ত বিষয়গুলাের প্রতি সরকার ও অন্যান্য মহলের লক্ষ রাখা দরকার।

১.নারীশিক্ষাকে জাতীয় পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচনা করতে হবে;

২.নারীশিক্ষার বিস্তারে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে;

৩.গ্রাম ও শহর বিবেচনায় উপযুক্ত কর্মসূচি প্রণয়ন করতে হবে;

৪.অবকাঠামােগত উন্নয়নের জন্য প্রয়ােজনীয় অর্থ বরাদ্দের ব্যবস্থা করতে হবে;

৫.একটি মনিটরিং সেল স্থাপন করে নারীশিক্ষার অগ্রগতি মূল্যায়ন করার প্রক্রিয়া চালু করতে হবে;

৬.দরিদ্র শিক্ষার্থীদের মাঝে বিনামূল্যে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করতে হবে;

৭.সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্যে প্রয়ােজনীয় প্রচার-প্রচারণার ব্যবস্থা রাখতে হবে;

৮.কর্মমুখী শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে;

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়াতে হবে। ৯.পর্যাপ্ত ও উপযুক্ত শিক্ষক নিয়ােগ করতে হবে;

১০.নারীশিক্ষাকে উৎসাহ প্রদানের জন্য যথাযথ কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা দিতে হবে।

উপসংহার:

নারীশিক্ষা আমাদের মতাে দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। দেশের মােট জনসংখ্যার অর্ধেকই নারী। তাই নারীসমাজকে অশিক্ষিত রেখে জাতীয় উন্নয়নের কথা কল্পনাই করা যায় না। এক্ষেত্রে নারীশিক্ষাকে অগ্রগণ্য কর্মসূচি দ্বারা বাস্তবায়নের দিকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হলে বড় ধরনের সুফল পাওয়া যাবে। দেশের উন্নয়নে নারীর ভূমিকা যথাযথভাবে সংযুক্ত করা গেলে দেশকে সমৃদ্ধির শীর্ষে নিয়ে যাওয়া সম্ভব

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস

  • সূচনা
  • বিজয় দিবসের প্রেক্ষাপট
  • বিজয় দিবসের তাৎপর্য
  • বিজয় দিবস উদ্যাপন
  • বিজয় দিবস এবং আমাদের প্রত্যাশা
  • বিজয় দিবস এবং আমাদের প্রাপ্তি
  • উপসংহার

সূচনা:

১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১। বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দিন। বাঙালির প্রতীক্ষা অবসানের দিন, শৃঙ্খল থেকে মুক্তির দিন। এ দিনে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। দীর্ঘ নয় মাস অনেক রক্তের পিচ্ছিল পথ মাড়িয়ে, অনেক প্রাণের বিনিময়ে বাঙালি জাতি সেদিন অর্জন করে তাদের প্রিয় স্বাধীনতা। মুক্তিকামী জাতির কাছে সে দিনটি ছিল অনেক প্রতীক্ষিত একটি দিন । আজও বাঙালি জাতি অস্তিত্ব উপলব্ধি করতে গেলেই ফিরে যায় সে দিনটির কাছে। তাই জাতীয় জীবনে বিজয় দিবসের আছে সুগভীর তাৎপর্য।

বিজয় দিবসের প্রেক্ষাপট:

১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে অবিভক্ত ভারতবর্ষ ভেঙে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। দ্বিজাতিতত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে আমাদের পূর্ববাংলা পূর্বপাকিস্তান নাম নিয়ে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে পূর্ব বাংলার মুসলমানরা স্বাধীন দেশ পাকিস্তান লাভ করলেও প্রকৃতপক্ষে তারা স্বাধীনতার ফল ভােগ করতে পারেনি। বাংলার অখণ্ডতাকে বাদ দিয়ে ধর্মভিত্তিক পাকিস্তান রাষ্ট্রের অংশীদার হয়ে তারা যে মস্ত বড় ভুল করেছে তা তাঁরা শীগগিরই উপলব্ধি করে। পশ্চিম পাকিস্তানিরা নিপুণ ছলে শশাষণ করতে চায় পূর্ব পাকিস্তানকে। উর্দুকে চাপিয়ে দিতে চায় বাঙালিদের ভাষা হিসেবে। এর প্রতিবাদে ফেটে পড়ে ছাত্রজনতা । তারা দাবি করে রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’। শুরু হয় আন্দোলন।

১৯৫২ সালের ২১-এ ফেব্রুয়ারি মিছিল করতে গিয়ে শহিদ হন সালাম, বরকত, রফিক, শফিক জব্বারসহ অনেকেই। গতি পেতে থাকে আন্দোলন। ঐতিহাসিক ছয় দফা এবং এগারাে দফার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সংঘটিত হয় ব্যাপক গণজাগরণ। ফলে ১৯৬৯ সালে সফল গণ-অভুত্থানের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচার আইয়ুব খানের পতন ঘটে। এর পর মার্শাল-ল -এর ক্ষমতা নিয়ে আসে ইয়াহিয়া খান। তীব্র আন্দোলনের চাপে ১৯৭০ সালে ঘােষণা করা হয় সাধারণ নির্বাচন। নির্বাচনে বাঙালির অবিসংবাদী নেতা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামীলীগের বিজয় ঘটে। সংগত কারণেই রাষ্ট্র পরিচালনার ভার তাঁকে দেওয়ার কথা। কিন্তু শুরু হয় ষড়যন্ত্রের নীল নকশা। ১৯৭১ সালের ২৫-এ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অতর্কিতে হামলা চালায়। নিরস্ত্র বাঙালির ওপর। তারা নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায় পিলখানা, রাজারবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। মধ্যরাতের পর হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। গ্রেফতারের পূর্বেই, অর্থাৎ ২৬-এ মার্চের প্রথম প্রহরে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। তার স্বাক্ষরিত ঘােষণা বার্তাটি তক্কালীন ইপিআর-এর ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে চট্টগ্রামে প্রেরণ করা হয়। এরপর চট্টগ্রামের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ২৬ ও ২৭-এ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নামে প্রচারিত হয় স্বাধীনতার ঘােষণা। সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে স্বতঃস্ফূর্ত মুক্তির সংগ্রাম। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর ১৯৭১-এর ১৬ই ডিসেম্বর আসে সােন দিন। বাঙালি জাতি স্বাধীনতা লাভ করে, অর্জন করে একটি মানচিত্র, একটি পতাকা।

বিজয় দিবসের তাৎপর্য:

যুদ্ধজয়ের মধ্য দিয়ে পতাকা ও ভূখণ্ড পেয়েছে বলেই জাতি সফল হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায় না। বরং এ বিজয়ের আছে সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য। স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল বলেই জাতির মেধাবী সন্তানেরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে

অসামান্য অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে। নিজ ভাষা, নিজ সংস্কৃতি পালন করতে পারছে বাঙালি জাতি। বিশ্বে আজ বাংলাদেশ আর বাঙালি জাতি এখন অচেনা নয় বরং বিশ্বকে সমৃদ্ধ করবার কাজে এদেশেরও আছে গৌরবময় অবদান।

বিজয় দিবস উদ্যাপন:

বাঙালি জাতির এ আনন্দের দিনটি নানাভাবে উদ্যাপিত হয়ে থাকে। সেদিন বাঙালিরা মিলিত হয় প্রাণের মেলায়। দেশের সকল সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ওড়ে আমাদের লাল-সবুজের পতাকা। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয় বিশেষ অনুষ্ঠান। রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যম, সরকারি-বেসরকারি রেডিও টিভি চ্যানেল গ্রহণ করে নানা উদ্যোগ। সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় বিশেষ ক্রোড়পত্র । বিদেশের বাংলাদেশি দূতাবাসগুলােতে ওড়ে পতাকা। দেশের সর্বস্তরের মানুষ গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করে তাদের বীর শহিদদের। বিজয়ের আনন্দে মানুষ স্মরণ করে এ দিনটিকে।

বিজয় দিবস এবং আমাদের প্রত্যাশা:

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ আমরা যেমন চেয়েছিলাম তেমনটা এখনাে পাইনি। স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক মুক্তি পেলেও আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তি এখনাে আসেনি। জনজীবনে এখনাে আসেনি নিরাপত্তার নিশ্চয়তা । দেশের বিপুল সংখ্যক শিক্ষিত বেকারের কর্মসংস্থান এখনাে অনিশ্চিত। বরং এর বিপরীতে দুর্নীতির ভয়াল রূপ দেখে আশ্চর্য না হয়ে পারা যায় না। স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তুলতে হলে প্রয়ােজন অর্থনৈতিক মুক্তি, সামাজিক নিরাপত্তা এবং সম্পদের সুষম বণ্টন।

বিজয় দিবস এবং আমাদের প্রাপ্তি:

অনেক না পাওয়ার মধ্যেও আমাদের প্রাপ্তি কম নয়। স্বাধীন বাংলাদেশ এখন শিক্ষায় যথেষ্ট এগিয়েছে। দেশের বাইরেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখছে। যােগাযােগব্যবস্থা, পল্লি জনপদে বিদ্যুতায়ন, স্বাস্থ্যখাত ইত্যাদি বিষয়ে উল্লেখযােগ্য উন্নতি ঘটেছে। ক্রীড়াক্ষেত্রেও সুখ্যাতি অর্জনে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পরিচিতি দিন দিনই বাড়ছে। তৈরি পােশাক, চামড়া, হিমায়িত চিংড়ি ইত্যাদির পর এবার জাহাজ রপ্তানিকারক দেশ হিসেবেও বাংলাদেশ পরিচিতি পাচ্ছে।

উপসংহার:

এক সাগর রক্ত আর ত্রিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের সোনার বাংলাদেশ। একটি নতুন দেশকে সােনার দেশ হিসেবে গড়ে তােলার দায়িত্ব সকলের। বিজয় দিবস স্বাধীনতাকামী বাঙালির পবিত্র চেতনার ধারক। সেই চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আমাদেরকে এগিয়ে যেতে হবে।

পদ্মা সেতু রচনা

  • সূচনা
  • ভৌগােলিক প্রেক্ষাপটে পদ্মা সেতুর গুরুত্ব
  • পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রেক্ষাপট
  • প্রতিবন্ধকতা ও বাংলাদেশের সক্ষমতা
  • পদ্মা সেতুর বর্ণনা
  • পদ্মা সেতু নির্মাণের সম্ভাব্য ব্যয়
  • পদ্মা সেতুর অর্থনৈতিক গুরুত্ব
  • শিল্পক্ষেত্রে পদ্মা সেতুর গুরুত্ব
  • কৃষিক্ষেত্রে পদ্মা সেতুর গুরুত্ব
  • দারিদ্র্য বিমােচনে পদ্মা সেতুর প্রভাব
  • পদ্মা সেতুর নেতিবাচক প্রভাব
  • পরিবেশের ভারসাম্যে পদ্মা সেতুর ভূমিকা
  • উপসংহার

পদ্মা সেতু: উন্নয়ন ও সম্ভাবনা রচনা

সূচনা:

পদ্মা সেতু বাংলাদেশের পদ্মা নদীর ওপর দিয়ে নির্মাণাধীন একটি সেতু। এই সেতু বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের সাথে উত্তর-পূর্ব অংশের সংযােগ ঘটাবে। এই সেতুকে কেন্দ্র করে মনে মনে স্বপ্ন বুনছে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের মানুষ। সকলের

আশা এই পদ্মা সেতু বদলে দেবে দেশের অর্থনীতি; উন্নত হবে মানুষের জীবনযাত্রা । স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় এই প্রকল্প খুলে দেবে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার।

ভৌগােলিক প্রেক্ষাপটে পদ্মা সেতুর গুরুত্ব:

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এদেশের বুক চিরে বয়ে চলেছে অসংখ্য নদনদী। তাই যাতায়াত ব্যবস্থায় আমাদের প্রতিনিয়তই নৌপথের আশ্রয় নিতে হয়। এতে যােগাযােগ ব্যবস্থায় দীর্ঘসূত্রিতা ও মন্থর গতি পরিলক্ষিত হয়। এই যাতায়াত ব্যবস্থাকে গতিশীল করার জন্য প্রয়ােজন হয় সেতুর। সেতু থাকলে নদীর দুই দিকের মানুষের যােগাযােগ ব্যবস্থায় যেমন উন্নতি হয়, তেমনি ব্যবসায়-বাণিজ্য ভালাে হওয়ায় মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটে।

পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রেক্ষাপট:

পদ্মা সেতু দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন । এজন্য এই অঞ্চলের মানুষ স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সরকারের কাছে তাদের দাবি বাস্তবায়নের কথা জানিয়ে এসেছে। অবশেষে এই সেতুর সম্ভাবনার কথা বিবেচনায় এনে ১৯৯৮ সালে প্রথম সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সমীক্ষা যাচাইয়ের পর ২০০১ সালে এই সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। কিন্তু অর্থের জোগান না হওয়ায় সেতুর ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে। পরবর্তীতে পদ্মা সেতু প্রকল্পের যাত্রা শুরু হয় ২০০৭ সালে । পরে ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে এই সেতুতে রেলপথ সংযুক্ত করে।

প্রতিবন্ধকতা বাংলাদেশের সক্ষমতা:

পদ্মা সেতু স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় প্রকল্প । বিভিন্ন সময় নানা প্রতিবন্ধকতার মুখােমুখি হয়েছে এই প্রকল্প। ২০০৯ সালের পর বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়নে আগ্রহ প্রকাশ করলে তাদের সাথে ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি হয় । কিন্তু ২০১২ সালে ঋণচুক্তি বাতিল করে বিশ্বব্যাংক; অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে পদ্মা সেতু প্রকল্প । পরবর্তীতে সরকার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘােষণা দেয়। ষড়যন্ত্রের বাধা জয় করে এগিয়ে চলে পদ্মা সেতুর কাজ; নিজস্ব অর্থায়নে দৃশ্যমান হতে থাকে স্বপ্নের পদ্মা সেতু।

পদ্মা সেতুর বর্ণনা:

নির্মাণ কাজ শেষ হলে পদ্মা সেতুই হবে বাংলাদেশের দীর্ঘতম সেতু। মূল সেতুর দৈর্ঘ্য হবে ৬ দশমিক ১৫ কিলােমিটার এবং প্রস্থ হবে ২১ দশমিক ১০ মিটার। এই সেতুটি হবে দ্বিতল; উপর দিয়ে চলবে যানবাহন এবং নিচে চলবে ট্রেন। সেতুটি নির্মিত হবে কংক্রিট এবং স্টিল দিয়ে । সেতুর দুই পাড়ে ১২ কিলােমিটার সংযােগ সড়ক নির্মিত হবে। নদীশাসনের জন্য চীনের সিনহাইড্রো কর্পোরেশন কাজ পেয়েছে। আর দুইপাড়ের সংযােগ সড়ক ও অবকাঠামাে উন্নয়নের জন্য কাজ দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের আবদুল মােমেন লিমিটেডকে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বুয়েট এবং কোরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে কর্পোরেশন অ্যান্ড অ্যাসােসিয়েটস সেতুর নির্মাণ কাজ তদারকি করবে। পদ্মা সেতুর রেল সংযােগ প্রকল্পে ১৪টি নতুন স্টেশন নির্মাণ এবং ৬টি বিদ্যমান স্টেশন উন্নয়ন ও অবকাঠামাে নির্মাণ করা হবে। নতুন ১৪টি স্টেশন হলাে— কেরানীগঞ্জ, নিমতলা, শ্রীনগর, মাওয়া, জাজিরা, শিবচর, ভাঙ্গা জংশন, নগরকান্দা, মুকসুদপুর, মহেশপুর, লােহাগড়া, নড়াইল, জামদিয়া ও পদ্ম বিল এছাড়া অবকাঠামাে উন্নয়নের ৬টি স্টেশন হলাে— ঢাকা, গেণ্ডারিয়া, ভাঙ্গা, কাশিয়ানী, রূপদিয়া ও সিঙ্গিয়া । মূল সেতুর পিলার হবে ৪২টি। এর মধ্যে নদীর মধ্যে ৪০টি ও নদীর দুই পাড়ে ২টি পিলার থাকবে । নদীর ভেতরের ৪০টি পিলারে ৬টি করে মােট ২৪০টি পাইল থাকবে। এছাড়া সংযােগ সেতুর দুই পাশের দুটি পিলারে ১২টি করে মােট ২৪টি পাইল থাকবে। পিলারের ওপর ৪১টি স্প্যান বসানাে হবে।সােনালি রং সূর্যের তাপ কম শােষণ করে বলে পদ্মা সেতুর রং হবে সােনালি । মূল সেতুর কাজ পেয়েছে চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড। এই সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হলে এর স্থায়িত্ব হবে ১০০ বছর।

পদ্মা সেতু নির্মাণের সম্ভাব্য ব্যয়:

২০০৭ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকার পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প পাস করে। এরপর ২০১১ সালে প্রকল্পের সংশােধিত ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। এরপর ২০১৬ সলে পদ্মা সেতু নির্মাণের ব্যয় দ্বিতীয়বারের মতাে সংশােধন করা হয়। সম্ভাব্য ব্যয় নির্ধারিত হয় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। প্রথম দিকে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা, আইডিবি এবং বাংলাদেশ সরকারের যৌথ অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ২০১২ সালে বিশ্বব্যাংক পদ্মাসেতু প্রকল্প থেকে নিজেদের সরিয়ে নিলে বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

পদ্মা সেতুর অর্থনৈতিক গুরুত্ব:

পদ্মা সেতুর অর্থনৈতিক গুরুত্ব সুদূরপ্রসারী। এই সেতু বাস্তবায়িত হলে দেশের দক্ষিণ- পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ২১টি জেলার মানুষের ভাগ্য বদলে যাবে। কেননা এই সেতুর মাধ্যমে রাজধানীর সাথে এই অঞ্চলের মানুষের সরাসরি সংযােগসাধন ঘটায় অর্থনীতি গতিশীল হবে। নিচে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পদ্মা সেতুর গুরুত্ব তুলে ধরা হলাে-

. শিল্পক্ষেত্রে পদ্মা সেতুর গুরুত্ব:

পদ্মা সেতু নির্মিত হলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞলের সাথে সরাসরি উত্তর-পূর্বাঞলের যােগাযােগ ঘটবে। ফলে এই অঞ্চলে গড়ে উঠবে নতুন নতুন শিল্পখাত । তাছাড়া এই সেতুকে কেন্দ্র করে গতিশীল হবে পায়রা সমুদ্র বন্দর। ফলে ব্যবসায়ের সুবিধার্থে স্থাপিত হবে নতুন শিল্পকারখানা।

. কৃষিক্ষেত্রে পদ্মা সেতুর গুরুত্ব:

বর্তমানে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সাথে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের যােগাযােগ ব্যবস্থা ভালাে না থাকায় মূল্য থেকে বর্ণিত হয়। সেতু নির্মাণের ফলে যাতায়াত ব্যবস্থা ওই অঞ্চলের মানুষ তাদের উৎপাদিত ফসলের ন্যা গতিশীল হবে। ফলে ওই অঞ্চলের কৃষকদের উৎপাদিত ফসল সহজেই দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌছে যাবে। এতে কৃষা ফসলের ন্যায্য মূল্য পাবে। এছাড়া কৃষিক্ষেত্রে নতুন নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার সহজ হবে। ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।

. দারিদ্র্য বিমােচনে পদ্মা সেতুর প্রভাব:

পদ্মা সেতু দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞলের মানুষের দারিদ্র্য বিমােচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এই সেতু নির্মাণের ফলে যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় সেখানে শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। ফলে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হবে। তাছাড়া সহজেই ওই অঞ্চলের মানুষ কাজের জন্য অন্যান্য স্থানে যেতে পারবে। এতে বেকারদের কর্মসংস্থান হবে।

পদ্মা সেতুর নেতিবাচক প্রভাব:

পদ্মা সেতুর নানারকম ইতিবাচক দিক থাকলেও এর কিছু নেতিবাচক প্রভাবও বিদ্যমান। পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে নদীর দুই পাড়ের কিছু মানুষের কর্মসংস্থান লােপ পাবে। এক্ষেত্রে নদী পারাপারে নিয়ােজিত লঞ্চ মালিকদের ব্যবসা বিলুপ্ত হবে। তা ছাড়া সবাই সেতু ব্যবহার করে পারাপার করায় লও ও ফেরিঘাটে অবস্থিত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী তথা দোকানদার, কুলি প্রভৃতি শ্রেণির লােকদের ব্যবসায় মন্দা দেখা দেবে। তবে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের পাশাপাশি সরকার যদি এসব ক্ষতিগ্রস্ত লােকদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে তাহলে পদ্মা সেতুর নেতিবাচক প্রভাবগুলাে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।

পরিবেশের ভারসাম্যে পদ্মা সেতুর ভূমিকা:

পদ্মা সেতু প্রকল্পকে কেন্দ্র করে নদীর দুই পাড়ে বিস্তীর্ণ এলাকায় নদীর পাড় বাধা হচ্ছে। ফলে ওই এলাকায় নদীভাঙন রােধ হবে। এছাড়া নদীর দুই পাড়ে এবং সংযােগ সড়কের রাস্তার দুই পাশে বৃক্ষরােপণ ক্র হচ্ছে। এতে এসব এলাকার পরিবেশের ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। সবুজায়নের ফলে ওই এলাকা মরুকরণের হাত থেকে রক্ষা পাবে। আবার বর্তমানে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ জ্বালানি হিসেবে কাঠ ব্যবহার করে বলে অবাধে বৃক্ষনিধন হয়। কিন্তু পদ্মা সেতু প্রকল্পের মাধ্যমে ওই অঞ্চলে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযােগ দেওয়া সহজ হবে। এতে মানুষের জ্বালানির চাহিদা পূরণ হবে। ফলে বৃক্ষনিধন কমে যাবে এবং পরিবেশের ভারসাম্য সুরক্ষিত হবে।

উপসংহার:

পদ্মা সেতু বাংলাদেশের মানুষের একটি স্বপ্নের নাম, যা দেশের অর্থনীতির চেহারা পাল্টে দেবে। এই সেতুর ফলে দেশের দক্ষিণাঞলে গড়ে উঠবে ব্যাপক শিল্পকারখানা, গার্মেন্টস, গােডাউন প্রভৃতি। ব্যবসা-বাণিজ্যে আসবে নতুন গতি। নানা অনিশ্চয়তাকে পাশ কাটিয়ে নিজেদের টাকায় বাঙালির স্বপ্ন এখন বাস্তবের পথে । এই সেতু অচিরেই বদলে দেবে দেশের অর্থনীতি, উন্নত করবে মানুষের জীবনযাত্রা।

Download From Google Drive

Download

Download From Yandex

Download

👀 প্রয়োজনীয় মূর্হুতে 🔍খুঁজে পেতে শেয়ার করে রাখুন.! আপনার প্রিয় মানুষটিকে “send as message”এর মাধ্যমে শেয়ার করুন। হয়তো এই গুলো তার অনেক কাজে লাগবে এবং উপকারে আসবে।